`থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’#মূল: নেপোলিয়ন হিল##অনুবাদক: মোঃ শওকত আলী##আলোচনা: ড. মো. আমিরুল ইসলাম#সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থের নাম: ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’।। মূল রচনা: নেপোলিয়ন হিল।। অনুবাদক: মোঃ শওকত আলী।। প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু।। প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১।। প্রকাশনা: পুথিনিলয়, ৩৮/২-ক, মান্নান মার্কেট, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।। মূল্য: পাঁচশত টাকা মাত্র।। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৮৮।। চিন্তাশক্তির সাথে...
" />`থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’
#মূল: নেপোলিয়ন হিল#
#অনুবাদক: মোঃ শওকত আলী#
#আলোচনা: ড. মো. আমিরুল ইসলাম#
সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রন্থের নাম: ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’।। মূল রচনা: নেপোলিয়ন হিল।। অনুবাদক: মোঃ শওকত আলী।। প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু।। প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১।। প্রকাশনা: পুথিনিলয়, ৩৮/২-ক, মান্নান মার্কেট, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।। মূল্য: পাঁচশত টাকা মাত্র।। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৮৮।।
চিন্তাশক্তির সাথে যখন অন্য কোনো আবেগ মিলিত হয়, তখন তা একটি চুম্বক শক্তিতে পরিণত হয়। এই শক্তি ইথারের তরঙ্গ হতে সমজাতীয় চিন্তাশক্তিকে আকর্ষণ করে। আবেগের সাথে মিশ্রিত চিন্তাশক্তি যে চুম্বক শক্তিতে পরিণত হয়, তাকে একটি বীজের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ গ্রন্থের লেখক নেপোলিয়ন হিল একজন বিখ্যাত আমেরিকান লেখক। তাঁর সকল রচনাই উচ্চমান ও ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় হলেও আজ আমরা কেবল ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ বইটি নিয়েই আলোচনা করবো। তাঁর রচনাসমূহ মূলত আত্মোন্নয়ন ও স্বয়ম্ভরতা অর্জনের বিষয়বস্তু নিয়েই লিখিত। বর্তমান গ্রন্থখানি পৃথিবীর সেরা একটি বেস্ট সেলার। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ তাঁর মাস্টার পিস রচনা এবং একই সঙ্গে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০টি গ্রন্থের অন্যতম। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক গ্রন্থখানি ধনী হওয়ার মূলমন্ত্র কিনা। সত্যিই ধনী হওয়ার মূলমন্ত্রই বটে। লেখকের ব্যক্তিজীবন ঘনিষ্ঠ পৃথিবীখ্যাত ৫০০ সফল ব্যক্তিত্বের সরাসরি সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করে গ্রন্থখানি রচিত হয়েছে। মানুষ নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত হয়না। ইচ্ছা শক্তি বা দৃঢ় মনোবল, পরিশ্রম, নিবিড় মনোযোগের সাথে ধৈর্য্য ধারণ করলে জীবনে সাফল্য ধরা দিতে বাধ্য। মানুষের হারানোর কিছু নেই, ইচ্ছা শক্তি ছাড়া। সবকিছু হারিয়ে গেলেও কেবল ইচ্ছাশক্তিতেই কীভাবে টিকে থাকা যায় এবং অকল্পনীয় সফল জীবন গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তা লেখক প্রমাণ করে দিয়েছেন আলোচিত গ্রন্থে। কেবল ধনসম্পদ অর্জন করেই নয়; সফলতা অর্জন করা যায় জ্ঞান অর্জনে, শিল্প, সাধনা, এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্য, শিল্পসাধনা, দর্শন এবং মনস্তত্ত্বের নিগুঢ় প্রতিভা অর্জনেও। যার যেমন জীবন, তার নিকট তার সফলতাও তেমন। লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, ভাবুক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী অথবা সৃজনশীল যেকোনো প্রতিভাধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার জন্যও গ্রন্থখানি আত্মোন্নয়নের কাজ করে। হতাশা ছেড়ে নতুন করে জীবন শুরু করার জাদুশক্তি রয়েছে ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ -এর মাঝে। কাজেই এর মাঝে ধনী হয়ে ওঠার মন্ত্রশক্তি রয়েছে; হোক তা মেধা, পা-িত্য, কিংবা কর্মক্ষেত্রে। যে ৫০০ সফল ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়ে গ্রন্থখানি রচিত হয়েছে, তাদের নেহাত ফিরিস্তি দিয়ে যদি গ্রন্থখানি রচিত হতো, তবে রচনার শতবর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে পৃথিবীর মানুষের কাছে আজও এত জনপ্রিয় হতোনা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সফল ব্যক্তিদের জীবন-দর্শন, ভাবনা, কল্পনাশক্তি, স্বপ্ন এবং সঙ্কট থেকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর জীবনঘেঁষা অভিজ্ঞতার আকড় যেন এই গ্রন্থ। কাজেই কেবল ধনীদের জন্যই নয়; ঐতিহাসিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং নৃতাত্ত্বিকদের জন্যও প্রেরণার ভা-াড় যেন এ বই। জীবন অভিজ্ঞতার প্রায়োগিক দর্শনের সমাহারে লেখক যেন জীবন অভিজ্ঞতার বাক-জটিলতা পরিহার করে এক বয়ানের রসায়ন তুলে ধরেছেন পাঠকের চোখের সামনে। মূল ইংরেজি থেকে ভাষান্তরে বিশেষ কুশলতা না থাকলে বাংলাভাষী পাঠকের পক্ষে এর স্বাদ আস্বাদন করাও সম্ভবপর হতো না। অনুবাদক নিজেও মেধাবী এবং ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র; পেশাগত জীবনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মক্ষেত্রে রত একজন চৌকস সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা হওয়ার কারণে, দেশেবিদেশের বিশেষ করে ইউরোপে অর্জিত ঋদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং ইংরেজির ব্যবহারিক দক্ষতাকে যেন অনুবাদের মাঝে উজার করে দিয়েছেন। কাজেই, অনুবাদ কেবল আক্ষরিক হলে তা পাঠকের মন ছুঁয়ে গেলেও মনোযোগ আটকে রাখতে পারে না। বর্তমান অনুবাদক বেশ মুন্সিয়ানার সাথেই অনুবাদটি সফলভাবে করতে সমর্থ হয়েছেন, এ দাবি খুব জোর দিয়েই করা যায়। বর্তমান অনুবাদ গ্রন্থের মাধ্যমে হিল’র চিন্তাসার, দর্শন, অর্থনীতি ভাবনা, সমাজচিন্তা, মনস্তত্ত্ব, শরীতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গের বিধিবদ্ধ শৈলী প্রায়শঃই যেন মূল পাঠের সংখ্যাতীত ও সহজবোধ্য বিকল্প হয়ে উঠেছে। অনুবাদে দুর্বোধ্য, সংখাতীত সংযোজনী টিকাভাষ্য এবং বাজারে প্রচলিত গতানুগতিক অনুবাদগ্রন্থের পথে না হেঁটে পাঠকের রুচি, পছন্দ এবং সীমাহীন কৌতূহলের নির্মেদ ভাষ্য যেন হয়ে উঠেছে ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’র বাংলা ভাষ্য। নেহাত ভাষান্তরের ফসল বিবেচনায় না নিয়ে এরূপ মনে করা যেতেই পারে যে অনুবাদকের চিন্তার প্রসার যেন মূল রচয়িতার নান্দনিক বিচারকে সামাজিক রূপান্তরের পরিপূরক করে তুলে ধরেছেন। নেপোলিয়ন হিলের চিন্তাশক্তি বা চিন্তাসূত্রের ফলিত ভাবনায় উদ্ভাসিত জীবন অভিজ্ঞতার বিস্তৃত পরিধির বিষয়ভিত্তিক বয়ান যেন জীবন পরিধির এক মলাটবদ্ধ রূপায়নও হয়ে উঠেছে। অনুবাদকের শব্দচয়নের ভাবনাগ্রন্থিও যেন ভাষাগত দূরত্বের বদ্ধতাকে ছিন্ন করে পাঠককে গভীরতর অধ্যয়নে প্রবৃত্ত করে। বাংলায় অনুবাদ গ্রন্থ নিয়ে উচ্চতর পাঠকসমাজে যে স্মিতহাস্য দেখা যায়, তার মোক্ষম জবাব হতে পারে শওকত আলীর অনুবাদ ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে নেপোলিয়ন হিল রচিত ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ গ্রন্থখানি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত হলেও বিগত কুড়ি শতক এবং বর্তমান একুশ শতক, এই দুই শতাব্দীর চিন্তার একটি ধারাবাহিক পুঁজিবাদী বিশ্বমনস্তত্ত্বের এক নিবিড় যোগ। আধুনিক এই দুই শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অগ্রযাত্রার উৎসাহী বিভিন্ন জনপ্রিয় তত্ত্বধারার বিস্ফোরিত যুগে এসে হিল’র চিন্তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা চ্যালেঞ্জিং রাষ্ট্রব্যবস্থার মাঝে নাগরিক জীবনে সুদূরপ্রসারি ব্যাপ্তি নিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক। এ কারণেই বেস্ট সেলার হিসেবে ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ গ্রন্থখানি আজও তার আবেদন হারায়নি। নিছক ধারাবাহিক ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি না হয়ে ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ আজও ব্যক্তি, সমাজ, ইতিহাসের সম্পর্ক; অন্তর্বস্তু ও আঙ্গিক গঠনের সম্পর্ক, ব্যক্তি থেকে সমাজের বিকাশ ও দায়বদ্ধতা, শিল্প, শিল্পের বিকাশ, উৎপাদন প্রভৃতি সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে মানুষের চূড়ান্ত উন্নতির কিছু রূপরেখার নির্দেশ করে যা মানুষেরই আত্মোন্নয়ন ও সর্বশেষ বিজয়ের হাসিটি প্রকাশ করতে পারে। নেপোলিয়ন হিল’র এই গ্রন্থখানির শিল্পশৈলীর কথা বলতে গিয়ে এ কথাই বলা প্রাসঙ্গিক যে এখানে বিশ্বের সফল ৫০০ ব্যক্তিত্বের উল্লেখ করা হয়েছে, যারা বর্তমান সমাজকে শিক্ষা দিতে পারে যে মানুষের চিন্তার বিশুদ্ধ সম্পদ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তার যথাযথ প্রয়োগ জীবনে সফলতা এনে দিতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ সফলতা চায়, চায় স্বাচ্ছন্দ্য মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের এই টানাপোড়েনে পরিশ্রম না করে বড়ো হওয়া অসম্ভব এবং অকল্পনীয়। বর্তমান গ্রন্থে এমন কিছু ব্যক্তি ও বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে যা নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা প্রবাহই কেবল নয়, জীবন ঘষে তুলে আনা সফলতার আখ্যানও বটে। আলোচিত গ্রন্থে মোট পনেরোটি অধ্যায়ে লেখক তার চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়ে দার্শনিক আঙ্গিকে অভিজ্ঞতার বিষয়গুলি প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বইয়ের পেছনের অনুপ্রেরণা হিসেবে জানা যায়, নেপোলিয়ন হিল যখন একটি জাতীয়ভাবে পরিচিত ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক হিসেবে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী অ্যান্ড্রু কার্নেগীর সাক্ষাৎকার নিতে যান, তখন কার্নেগি হিলকে জীবনে সাফল্য লাভের যে মূলমন্ত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, তা ছিল জাদুশক্তির মতোই বিস্ময়কর। কার্নেগি হিলকে এই পরামর্শই দিয়েছিলেন যে অর্থ, শক্তি, অবস্থান, প্রতিপত্তি, প্রভাব বা সম্পদ আহরণের মূল চাবিকাঠি হলো মাস্টার মাইন্ড। সুদীর্ঘ বিশ বছর ধরে চলমান গবেষণা যাত্রায় বিভিন্নভাবে সফল পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির স্বচেষ্টায় কোটিপতি হয়ে ওঠার সাক্ষাৎকারই নেপোলিয়ন হিলের বর্তমান গ্রন্থের অনুপ্রেরণা। নি¤েœ সফলতার ধাপগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
প্রথম অধ্যায়ে সূচনা বক্তব্যে মানুষের সাফল্যের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যে সীমাবদ্ধতার কথা হিল বলেছেন, তা হলো, ‘তাদের অভ্যাস হলো তারা নিজস্ব ধারণা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রতিটি বস্তু ও ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করে থাকে’। বিমা কোম্পানীতে কর্মরত একজন মি. ডার্বি যখন একের পর এক ব্যক্তির কাছে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন, তখনও হতাশ না হয়ে তিনি ধৈর্যসহকারে হাসিমুখে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। মি. ডার্বি ও তার চাচা কৃষ্ণাঙ্গ শিশু এবং সোনার খনির গল্পটির মধ্যে সেই শিক্ষাটি আমাদেরকে যেন হতাশ না হয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করার শক্তির যোগান দেয়। এ প্রঙ্গে সোনার খনি ব্যবসায়ীর গল্পটি আমাদেরকে শিক্ষা দেয়, ‘পথ যত কঠিনই হোকনা কেন, সামনে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখতে হবে’। সোনা হতে তিন ফিট দূরে অবস্থান করেও খনন কাজে ইতি টানায় তিনি যে ভুল করেছিলেন তা আমাদেরকে কর্মোদ্যম না হারিয়ে লেগে থাকার প্রেরণা যোগায়।
সম্পদ ও সমৃদ্ধি অর্জনের প্রথম ধাপে হিল আমদের শিখিয়েছেন, আকাক্সক্ষাই সকল প্রকার সাফল্যের সূচনা বিন্দু। যে কোনও লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবশ্যই একটা জ্বলন্ত আকাঙক্ষা থাকতে হয়, বিশ্বাসের সাথে মিল রেখে এটি অর্জন করতে হয়। বার্নেসের এডিসনের সাথে সাক্ষাৎ, হাল ছেড়ে না দেওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম এবং চূড়ান্ত সফলতার এই উদাহরণ মানবজীবনের জন্য এক অতুলনীয় শিক্ষা। যখন হিল বলেন,‘ইচ্ছাশক্তি প্রকৃতিকেও হার মানায়’। বধির সন্তানকে নিয়ে সকল প্রচেষ্টাই যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত, তখন প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সন্তানের ইতিবাচক শ্রবণশক্তির বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কে শ্রবণযন্ত্র সংযোজন করে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের যে দৃষ্টান্ত, তা মানুষকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতা, বেঁচে থাকার কিংবা আপাত সম্ভাবনাহীন জীবনেও নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। সেই পিতার স্বগতোক্তি, ‘ভাগ্যের চাকা অদ্ভুত কিছু মোড় নিল। এর ফলে ভবিষ্যতের বোবা ও বধিরদের ত্রুটি সংশোধন করার জন্য আমার এবং আমার পুত্র ব্লেয়ারের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। কারণ, আমার জানামতে, আমরা দু’জন একমাত্র জীবন্ত ব্যক্তি, যারা এই সত্য আবিষ্কার করেছি- বোবা ও বধিরদের ত্রুটিকে সংশোধন করে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। এটি একজনের ক্ষেত্রে যেহেতু কার্যকরী হয়েছে, অতএব অন্যদের বেলায়ও এটি কার্যকরী হবে’।
নেপোলিয়ন হিলের মতে, সম্পদ অর্জনের দ্বিতীয় ধাপ হলো বিশ্বাস। কাক্সিক্ষত সাফল্যকে মনশ্চক্ষুতে দেখা এবং তা বিশ্বাস করা কিংবা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং আকাক্সক্ষার প্রাপ্যতায় বিশ্বাস অর্জনই সম্পদ অর্জনের দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে কাজ করে। অবচেতনতার কাছে নিশ্চয়তা বা বারবার পরামর্শের মাধ্যমে আপনি বিশ্বাসের আবেগ বিকাশ করতে পারেন, যা আপনার আকাক্সক্ষাকে তাদের শারীরিক বা আর্থিক সমতুল্যে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজনীয়। যে মনের মধ্যে কোনো বিশ্বাস নেই, সেখানে কীভাবে বিশ্বাস তৈরি করা যাবেÑ তা বর্ণনা করা খুবই কঠিন। এটা ততটাই কঠিন যতটা কঠিন একজন অন্ধকে বর্ণনা দিয়ে লাল রং বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। যে কখনো রঙই দেখেনি, আপনি তার কাছে যা বর্ণনা করছেন তা কোনো কিছুর সাথেই তুলনা করা সম্ভব হবে না। বিশ্বাস হলো একটি মানসিক অবস্থা এবং তেরোটি নীতিকে আয়ত্তে আনার মাধ্যমে ইচ্ছা করলেই আপনি বিশ্বাস তৈরি করতে পারেন। … অবচেতন মনে বারবার প্রত্যয়ন প্রেরণ করাই হলো ইচ্ছাকৃতভাবে বিশ্বাস তৈরির একমাত্র জানা পদ্ধতি। বিশ্বাস একটি মাসিক অবস্থা, যা অটোসাজেশনের সাহায্যে প্রভাবিত করা যায়।… বিশ্বাস একটি মানসিক অবস্থা এবং আত্মপরামর্শের মাধ্যমে এটি অর্জন করা যায়।
অবচেতন মনকে প্রভাবিত করার মাধ্যম হলো অটোসাজেশন কিংবা স্ব-পরামর্শ। এটি সম্পদ অর্জনেরর তৃতীয় ধাপ। অবচেতন মনকে প্রভাবিত করার মাধ্যম অটো-পরামর্শটি সচেতন মন থেকে অবচেতনের আসনে চিন্তার চ্যানেলগুলিকে স্ব-নির্দেশিত যোগাযোগে এবং স্ব-পরিচালিত উদ্দীপনা ব্যবহার বোঝায়। সচেতন মন প্রায়শঃই সংবেদনশীল ছাপগুলির প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, আপনার ইচ্ছাগুলিকে তাদের শারীরিক সমতুল্যে অনুবাদ করার জন্য উপযুক্ত চিন্তাভাবনা তৈরি করতে স্বয়ংক্রিয়-পরামর্শ অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত। মানুষ তার চেতন মনে যে চিন্তাকে ঠাঁই দেয়, সেই চিন্তাই প্রভাব বিস্তারকারী চিন্তায় পরিণত হয়। সাফল্য অর্জনের ছয়টি ধাপের চতুর্থটিতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, “আপনার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপর দেওয়ার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এখনই কাজ শুরু করুন।”
সাধারণ জ্ঞান বা যা সাধারণত স্কুলগুলিতে শেখানো হয়, আপনাকে ধন সংগ্রহ করতে সহায়তা করবে না, বা নিজস্ব নিজস্ব বিশেষায়িত জ্ঞানও দেবে না। বরং জ্ঞান অর্জনের পরে আপনাকে কীভাবে সংগঠিত করতে এবং ব্যবহার করতে হবে তা অবশ্যই শিখতে হবে। আপনার ব্যবসা তৈরির লক্ষ্যে বা লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত জ্ঞানের অভাব যদি থাকে তবে আপনি “মাস্টার মাইন্ড” গ্রুপ গঠন করে অন্য ব্যক্তির সাথে নিজের জ্ঞানের পরিপূরক করতে পারেন।
বিশেষায়িত জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণকে হিল সম্পদ অর্জনের চতুর্থ ধাপ হিসেবে দেখিয়েছেন। অর্থ সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট উপায় ও বাস্তব পরিকল্পনার মাধ্যমে যতক্ষণ না জ্ঞানকে সংগঠিত করা ও বিচক্ষণতার সাথে তা ব্যবহার করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান টাকাপয়সাকে আকর্ষণ করতে পারে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার ফারাক নিয়েও হিল খোলাখুলি কথা বলেছেন। ‘জ্ঞানই শক্তি’ কথাটি নিয়েও তিনি নতুন করে আলোকপাত করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘জ্ঞান একটি সম্ভাব্য শক্তিমাত্র। এটি কেবল তখনই শক্তিতে পরিণত হয়, যখন কাজের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী জ্ঞানকে সংগঠিত করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা হয়’। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা নিয়েও তার স্পষ্ট বক্তব্য, ‘সভ্য দুনিয়ার কাছে পরিচিত শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য দায়ী হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা। জ্ঞান অর্জনের পর ছাত্ররা কীভাবে সেই জ্ঞানকে সংগঠিত ও ব্যবহার করবেÑ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জীবনে সাফল্য লাভের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও বাস্তবিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেও মানুষ জীবনে চোখধাঁধানো সাফল্য লাভ করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত হিসেবে হিল হেনরি ফোর্ডের জীবনের সাফল্য অর্জনের প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন।
কল্পনাশক্তিকে মনের কর্মশালা বা কারখানা হিসেবে অভিহিত করে হিল ধনসম্পদ অর্জনের পঞ্চম ধাপ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করেছেন। মানুষের চিন্তাশক্তিকেও হিল ‘কৃত্রিম কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীল কল্পনাশক্তি এই দু’টি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে হিল বলেন, ‘সকল ঐশ্বর্য লাভের সূচনাবিন্দু হলো ধারণা। ধারণার উৎপত্তি হয় কল্পনাশক্তি থেকে’। অর্থাৎ, কল্পনা হলো মানবজাতির এক অনন্য অনুষঙ্গ; যা আকৃতি দেয়, গঠন করে এবং আকাক্সক্ষাকে কার্য দেয়। হিল দু’টি পদ্ধতির মাধ্যমে কল্পনাকে কার্যকর করার কতা বলেন, প্রথমত, কৃত্রিম কল্পনা যা পুরনো ধারণা বা পরিকল্পনাটিকে অভিজ্ঞতার নতুন সংমিশ্রণে সজ্জিত করে; এবং সৃজনশীল কল্পনা, যা দৃঢ়তম আকাক্সক্ষায় উদ্দীপিত হয়ে অন্যান্য মানুষ এবং ইথার থেকে চিন্তার কম্পনগুলি গ্রহণ করে, অসীম বুদ্ধিমত্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং নতুন ধারণার বিকাশ করে। জাদুর কেটলি, ডাক্তার, কেরানি, চিরকুট, বাষ্প এবং নতুন পানীয় উদ্ভাবনের মধ্যে থেকে নেপোলিয়ন হিল সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনাই করেছেন, যেখানে পৃথিবীকে বদলে দিতে কল্পনাশক্তি জীবনের সফলতা অর্জনের জাদুমন্ত্র হিসেবেই কাজ করে।
সুসংগঠিত পরিকল্পনার আলোকে কাজের সাহায্যে আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়াকে হিল সম্পদ অর্জনের ষষ্ঠ ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, সহজাত গুণাবলি এবং কল্পনাশক্তির সাহায্য নিয়ে নিশ্চিত সাফল্যের জন্য প্রয়োজন নিখুঁত পরিকল্পনা। হিলের ভাষায়, ‘আপনি যে কাজে নিয়োজিত আছেন, সেটি আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাফল্যের নিশ্চয়তার জন্য আপনার প্রয়োজন নিখুঁত পরিকল্পনা’। ইচ্ছাটিকে শারীরিক বা আর্থিক সমতুল্যে অনুবাদ করার জন্য আপনাকে অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট, ব্যবহারিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং এটি কার্যকর করতে হবে। এই অধ্যায়ের বিবরণগুলি কীভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে এবং পাঠকের সুবিধার্থে সেগুলি কীভাবে কার্যকর করছে তা নিশ্চিত করে। মন্দাজনিত কারণে এক মিলিয়ন ডলারের অধিক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও স্যামুয়েল ইনসাল সাময়িক বিপর্যয়কে জীবনের ব্যর্থতা হিসেবে না নিয়ে কীভাবে নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে উত্তরণ লাভ করেছিলে তা দেখিয়েছেন। সুসংগঠিত পরিকল্পনার সাথে নেতৃত্ব, নেতৃত্বের গুনাবলি, সাফল্য এবং ব্যর্থতার কারণগুলিও বর্তমান অধ্যায়ে চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে। গণমাধ্যমের কাজে যুক্ত থেকে রাষ্ট্রের জনগণের সেবাদানে নিজের মেধার যথাযথ ব্যবহারের কথাটিও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করে লেখক যথাযথ দার্শনিক চিন্তারই বিকাশ ঘটিয়েছেন। সার্ভিস বা চাকরিকে তিনি সেবা হিসেবে বিবৃত করে মানবিক বিকাশের ধারাকেই যেন নির্দেশনা দিয়েছেন। আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ পূর্বের ভবিষ্যদ্বাণীতে তিনি মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে অংশীদারীত্বমূলক পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। মালিক, কর্মচারী এবং জনগণ, যাদেরকে তারা সেবা প্রদান করে এই তিনটি স্তরকে তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মালিক এবং কর্মচারী উভয়কে একই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করে তিনি দেখিয়েছেন তারা যেন একত্রে সর্বসাধারণের সেবা প্রদান করেন। মালিক এবং কর্মচারী বা শ্রমিকের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে হলে তা থেকে সেবাপ্রত্যাশী গ্রাহক বা জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এ বিষয়টিও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব কিংবা দীর্ঘসূত্রতার ওপর নিয়ন্ত্রণকে সম্পদ অর্জনের সপ্তম ধাপ হিসেবে হিল বর্ণনা করেছেন। বিলম্ব এবং এর অনিবার্যতা ব্যর্থতার প্রধান কারণ। অন্যদিকে প্রায় ২৫০০০ -এর অধিক নারী-পুরুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে ধন-সম্পদের অধিকার লাভের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে হিল যে ৩০টি ব্যর্থতার কারণ চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে শীর্ষে ছিল ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতার অভাব’। নারী এবং পুরুষেরা দ্রুত নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অভাবে এবং অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধীরে ধীরে তাদের মন পরিবর্তন করে কীভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তা তিনি স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এই অধ্যায়টি সেই শিক্ষা দেয় যে কীভাবে অন্যের মতামত দ্বারা চালিত না হয়ে, নিজ বুদ্ধিমত্তা বা নিজের পরামর্শে (এবং আপনার মাস্টার মাইন্ড গ্রুপের) ওপর আস্থা রাখা যাতে আপনি দৃঢ় মনোবল পোষণ করেন ও উৎপাদনশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, যা আপনার সাফল্য নিশ্চিত করে। ‘হয় মুক্তি লাভ, না হয় মৃত্যু’ আব্রাহাম লিংকনের এই বিখ্যাত মুক্তির ঘোষণা কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। এই ঘোষণায় হাজার হাজার বন্ধু ও সমর্থক তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারে, তা জেনেই তিনি সিদ্দান্ত নিয়েছিলেন। তিনি এটিও জানতেন যে, তাঁর এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে গেলে হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করবে। অবশেষে এটি লিংকনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অধিকার আদায়ের এ কালজয়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সাহসের প্রয়োজন ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাঙালির অবিসম্বাদিত নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ১৯৭১ সালের রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণের তাৎপর্যও এমন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি যে ডাক সেদিন দিয়েছিলেন তার ফল স্বাধীন বাংলাদেশ। কাজেই, অধিকার আদায়ের কালজয়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সাহস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের আগে ব্রিটিশ সৈন্যদের বেয়নেট চার্জ, গুলি এবং গোলার বিরুদ্ধে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ বোস্টনের অধিবাসীদের বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গটিকেও সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছেন নেপোলিয়ন হিল।
বিশ্বাস তৈরি বা বিশ্বাসকে প্ররোচিত করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন বা টেকসই প্রচেষ্টা প্রয়োজন, সম্পদ অর্জনের অষ্টম ধাপ হিসেবে হিল যার নাম দিয়েছেন ‘অনড় মনোভাব’। আকাক্সক্ষাকে সমতুল আর্থিক বস্তুতে পরিণত করার জন্য প্রয়োজন অনড় মনোভাব। অনড় মনোভাবের ভিত্তি হলো ইচ্ছাশক্তি।
বেশিরভাগ মানুষ বিরোধিতার প্রথম অভিজ্ঞতা লাভ করে নিকটতর লোকেদের কাছে থেকে। যাই হোক, যে কোনও একটির লক্ষ্যে পৌঁছতে বা তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির সাথে সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি। হিল অধ্যাবসায়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বলেছেন, ‘অল্প আগুন যেমন অল্প তাপ উৎপন্ন করে, ঠিক তেমনি দুর্বল আকাক্সক্ষা থেকে দুর্বল ফলাফল পাওয়া যায়’।
সম্পদ অর্জনের নবম ধাপ হিসেবে মাস্টার মাইন্ডের ক্ষমতাকে চালিকাশক্তি তথা ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবে হিল অভিহিত করেছেন। ‘টাকাপয়সা অর্জনের জন্য ক্ষমতা প্রয়োজন! টাকাপয়সা সংগ্রহের পর তা ধরে রাখার জন্যও ক্ষমতা প্রয়োজন’। একটি মাস্টার মাইন্ড গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে ব্যক্তিগণ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে এবং প্রয়োাগ করতে পারে, বিভিন্ন শক্তি এবং দৃষ্টিভঙ্গিযুক্ত ব্যক্তিদের একটি জোট যারা তাদের জ্ঞান এবং একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করে ও সমন্বিত হয়ে কাজ করে। মাস্টার মাইন্ড গ্রুপগুলি উভয়ই অর্থনৈতিক সুবিধার (ধনী) পাশাপাশি মানসিক বেনিফিট নিয়ে আসে (একটি মহাজাগতিক সম্প্রীতি যা “তৃতীয় মন,” বা আধ্যাত্মিক একক শক্তি উচ্চতর ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিচালিত হয়)। অর্থাৎ, মাস্টার মাইন্ড হলো ‘একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মনের মিল রয়েছে এমন দুই বা ততধিক ব্যক্তির জ্ঞান ও চেষ্টার সমন্বয় সাধন’।
সম্পদ অর্জনের দশম ধাপ হিসেবে নেপোলিয়ন হিল যৌনতার রূপান্তর বা সেক্স ট্রান্সমিউটেশন এর গুঢ় রহস্যটিকে চিহ্নিত করেছেন। ‘যৌন আবেগ মনের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে। এ বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে মনের এই অবস্থাটিকে সাধারণত শরীরের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে গণ্য করা হয়। আবার অধিকাংশ মানুষ এটির ভ্রান্ত প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে’। হিল যৌন আবেগের সাথে তিনটি গঠনমূলক সম্ভাবনা জড়িত থাকার কথা বলেছেন, “১. মানবজাতির অস্তিত্বকে রক্ষা করা ২. স্বাস্থ্যকে রক্ষা করা ৩. মাঝারি মানের ব্যক্তিকে রুপান্তরের মাধ্যমে প্রতিভাবান ব্যক্তিতে পরিণত করা। … মানুষের সকল আকাক্সক্ষার মধ্যে যৌন আকাক্সক্ষা সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। এ আকাক্সক্ষার দ্বারা পরিচালিত হলে মানুষের কল্পনাশক্তির গভীরতা, সাহস, ইচ্ছাশক্তি, অনড় মনোভাব এবং সৃজনশীলতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যে বিষয়গুলো অন্য সময় তাদের কাছে অজানা থেকে যায়। যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আকাক্সক্ষা এত প্রবল ও প্ররোচনামূলক যে, মানুষ এ আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য স্বেচ্ছায় জীবন ও সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে থাকে। এই প্রেরণাদায়ক শক্তিকে যখন নিয়ন্ত্রণ করে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করা হয়, তখন কল্পনাশক্তির গভীরতা, সাহস ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাভাবিক গুণাবলি প্রকাশ পায়। অর্থসম্পদ থেকে শুরু করে সাহিত্য, কলা অথবা যেকোনো পেশায় এগুলোকে গঠনমূলক প্রবল শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে”। নিখরচায় শারীরিক – সর্বাধিক সৃজনশীলতার চেয়ে যৌন রূপান্তরকে শারীরিক আকাক্সক্ষা এবং তার সাথে সম্পর্কিত শক্তিগুলি অন্য আউটলেটে জড়িত করে। এই নীতিটির সাথে সম্পর্কিত একটি হ’ল উপযুক্ত সঙ্গী বাছাই করার গুরুত্ব।
অবচেতন মন বিষয়টিকে হিল সংযোজক গ্রন্থি বা সংযোগ লিঙ্ক হিসেবে সম্পদ অর্জনের একাদশ ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হিল অবচেতন মনকে মানুষের সীমাবদ্ধ মন এবং অসীম বুদ্ধিমত্তার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বর্ণনা করেন, যা মানবকে সর্বজনীন মনের অসীম প্রজ্ঞাকে কাজে লাগায়। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে মানসিক প্রবণতাগুলি তাদের আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক সমতুল্যে রূপান্তর করার জন্য এটিই একমাত্র মাধ্যম। তার ভাষায়, ‘অবচেতন মন দিনরাত কাজ করে। কোনো এক অজানা পদ্ধতির সাহায্যে অবচেতন মন অসীম প্রজ্ঞার শক্তিকে কাজে লাগায় এবং এই শক্তির মাধ্যমে ইচ্ছাকে স্বপ্রণোদিতভাবে সমতুল বস্তুতে রূপান্তর করে’। ‘অবচেতন মন মানুষের সসীম মন ও অসীম প্রজ্ঞার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে কাজ করে।…অবচেতন মনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সৃজনশীল প্রচেষ্টার সম্ভাবনা ব্যাপক ও কল্পনাতীত। কোনো কোনো ব্যক্তিকে সেগুলো ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে’।
সম্পদ অর্জনের দ্বাদশ ধাপে মস্তিষ্ককে চিন্তার জন্য একটি সম্প্রচার ও প্রাপ্ত স্টেশন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সৃজনশীল কল্পনাশক্তি হলো মস্তিষ্কের গ্রাহকযন্ত্র যা অন্য ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক হতে প্রেরিত চিন্তাভাবনাকে গ্রহণ করে থাকে। এটি ব্যক্তির সচেতন মন ও চিন্তার উদ্দীপকের চারটি উৎসের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মস্তিষ্ক ও এর অত্যন্ত জটিল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জানতে পেরেছে। মস্তিষ্ক ও এর জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চিন্তাশক্তি কাক্সিক্ষত বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। ইথারের মাধ্যমের মাধ্যমে, রেডিও সম্প্রচারের নীতি দ্বারা যুক্ত একটি ফাঙ্কশনে প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক অন্যান্য মস্তিষ্কের দ্বারা প্রকাশিত চিন্তার কম্পনগুলি তুলতে সক্ষম তিনি সেই প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেছেন যার দ্বারা মন বাহ্যিক কম্পন দ্বারা উদ্দীপিত হয় এবং এই সংবেদনশীল উদ্দীপনাগুলিতে মনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আবেগগুলি ব্যবহার করার জন্য একটি পদ্ধতি সরবরাহ করে।
নেপোলিয়ন হিলের ত্রয়োদশ নীতিটি হলো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা ষষ্ঠ সংবেদন যা জ্ঞানের মন্দিরের প্রবেশ দ্বার হিসেবে পরিচিত। ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হলো অবচেতন মনের এমন একটি অংশ, যেটিকে“সৃজনশীল কল্পনাশক্তি হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে। এটিকে গ্রাহকযন্ত্রকেও বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে মনে কোনো ধারণা, পরিকল্পনা, চিন্তার উদয় হয়। মনে চিন্তার উদয় হওয়াকে কখনো কখনো ‘পূর্বাভাস’ বা ‘দৈববাণী’ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে’।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা ষষ্ঠ সংজ্ঞাকে অবচেতন মনের ক্রিয়েটিভ কল্পনাও বলে যার দ্বারা মানুষ নিজে চষ্টা করেই অসীম বুদ্ধিমত্তার সংযোগ পায়। হিল এই নীতিটিকে তাঁর সাফল্যের দর্শনের আইনটির “শীর্ষ” হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ এটি প্রথম বারোটি নীতি আয়ত্ত করার পরেই এটি উপলব্ধিযোগ্য এবং প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এই তেরো সাফল্যের নীতিগুলি বাস্তবায়নের জন্য আপনাকে দর্শন গ্রহণের জন্য আপনার মন প্রস্তুত করতে হবে। আপনার মানসিকতাকে প্রধান করে তোলার প্রথম পদক্ষেপ হলো আপনাকে যে তিনটি শত্রুকে পরাস্ত করতে হবে তা অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ, বোধগম্যতা, সিদ্ধান্তহীনতা, সন্দেহ এবং ভয়। সর্বশেষ অধ্যায়ে ছয়টি মূল আশঙ্কার প্রতিকারের রূপরেখা ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যা সচেতন অবস্থায় লুকিয়ে থাকলেও মানুষ তাদের ধন-সম্পদের পিছনে ফিরে আসে: দারিদ্র্যের ভয়, সমালোচনার ভয়, অসুস্থ স্বাস্থ্যের ভয়, ক্ষতির ভয় ভালোবাসার, বার্ধক্যের ভয় এবং মৃত্যুর ভয়। মানুষের দ্বিধার চলক তার অগ্রগতিকে কীভাবে বাধাগ্রস্ত করে, কেবল সে বিবৃতিই নয়; তা থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন নেপোলিয়ন হিল। ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ গ্রন্থখানি এ কারণেই অনন্য এবং মাস্টার পিস।
নেপোলিয়ন হিল বিরচিত, মোঃ শওকত আলী অনুদিত ‘থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ গ্রন্থখানি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের নিকট একটি প্রাঞ্জল অনুবাদ গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হবে এবং আত্মোন্নয়ন ও চিন্তাশক্তির বিকাশ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, এই প্রত্যাশা।
There is no related posts.