ড. মো. আমিরুল ইসলাম
জীব জগতে মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে উন্নত বলেই সে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জীব। মানুষের যে ব্যাপক ক্রমোন্নতি হয়েছে তার মূল কারণ এটাই যে মানুষ তার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করতে তার জ্ঞানকে প্রয়োগ করেছে। আধুনিক যুগে এই জ্ঞানের ভিত্তি নির্মাণ করছে বিদ্যালয় তথা স্কুল। স্কুলশিক্ষার মান উন্নয়ন হলে ‘স্বাভাবিকভাবে উচ্চশিক্ষার মান উন্নীত হতে থাকে’ -এই সহজবোধ্য কথাটি জাতিসংঘের শিক্ষা-সম্পর্কিত বিভাগ ইউনেস্কোর। বাস্তবিক অর্থেই স্কুলশিক্ষার মানই একটি দেশের কেবল উচ্চশিক্ষা নয়, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থারই মান নির্ধারণ করে। বাঙালির সংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস যথেষ্ট পুরাতন। ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশ অধিকার করার আগে আমাদের একটা সুগঠিত পাঠশালা-ব্যবস্থা ছিল। সেখানে টোল-মক্তবে তথাকথিত নিন্মবর্ণের ছেলেদের আরবি-ফারসি-সংস্কৃত পড়ালেখার কিছু প্রমাণ পরিদৃষ্ট হয়। পরবর্তীকালে রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিবাদের জের ধরে সংস্কৃত নির্ভর টোলশিক্ষার পরিবর্তে যে ইংলিশ এডুকেশন প্রবর্তিত হয় তা বস্তুত গড়ে ওঠে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায়। তিনি ইংলিশ এডুকেশন প্রসারেই তৎপর হন -তবে তা বাংলা মাধ্যমে। প্রসঙ্গত, ইংলিশ এডুকেশন বলতে রামমোহন কেবল ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বোঝাননি, বুঝিয়েছিলেন বিজ্ঞান, শারীরবিদ্যা ইত্যাদিও। রামমোহন প্রবর্তিত এবং বিদ্যাসাগর নির্মিত শিক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে আমরা ‘আধুনিক বাঙালি’ হয়ে উঠেছি।
চলনবিল অঞ্চলের আধুনিক শিক্ষার অতীত রূপটি ধরতে হলে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার অতীত ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত অবয়ব তুলে ধরা দরকার। ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-দা-গামার দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কালিকট বন্দরে অবতরণ ইউরোপীয় বণিকদের জন্যে ভারতবর্ষের দ্বার উন্মুক্ত করে। অতঃপর একে একে ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজদের আগমনে ভারতবর্ষের সাথে ইউরোপের যোগাযোগ ঘনিষ্টতর হয়। পর্তুগীজরা ১৫১৭ সালে মালদ্বীপ থেকে প্রথম বাংলায় আসে এবং সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের শাসনকালে তারা বাংলার হুগলী, চট্টগ্রাম, যশোর, ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালী, ফরিদপুর, সন্দ্বীপ প্রভৃতি স্থানে বসবাস শুরু করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্মান্তকরণের কাজ চালিয়ে যায়। ১৫১৮ সালে হুগলি চার্চের সাথে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা পর্তুগীজ ভাষার সাথে স্থানীয় ভাষার চর্চা করতে থাকে। ১৬০০ সালের ৩১ শে জানুয়ারি মহারানী এলিজাবেথ লন্ডন শহরের কতিপয় উদ্যোগী বণিক সমন্বয়ে গঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতবর্ষে ও পূর্ব গোলার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার দিয়ে একটি সনদ প্রদান করেন। ভারতবর্ষে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপীয় অন্যান্য গোষ্ঠীর মাঝে নিজেদের জায়গা করে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা। কাজেই তাদের প্রথম দেড়শ বছর ইউরোপীয় অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহেই কেটে যায়।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হলে তাদের অবস্থান শক্ত হয়। ১৭৬৫ সালে সম্রাট শাহআলম কর্তৃক বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে কোম্পানি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। উপমহাদেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে দেখা যায় ১৭০৯ সালে কলকাতার পুরোহিত রেভারেন্ড ব্রেয়ার সর্বপ্রথম ইউরোপীয়ান স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, কিন্তু ১৭২০ সালের পূর্বে স্কুলটি চালু হয়নি। ১৭২০-১৭৩১ এর মধ্যে রেভারেন্ড বেলামী কলকাতায় একটি চ্যারিটি স্কুল স্থাপন করেন। ১৭৫৮ সালে লর্ড ক্লাইভের আমন্ত্রণে মাদ্রাজ থেকে বিখ্যাত মিশনারী কিয়েরনানডার কলকাতায় এসে ৪৮ জন ছাত্র নিয়ে একটি স্কুল খোলেন। গভর্নর জেনারেলের উদ্যোগে ১৭৮৯ সালের ২১ ডিসেম্বর “Free school society of Bengal” গঠিত হয়। এ সময় বেশকিছু চ্যারিটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। আঠারো শতকের শেষে এবং ঊনিশ শতকের প্রথমে অনেক হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মোটামুটি ইংরেজি শিখতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সরকারি বা বেসরকারি অফিসে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মিলকারখানায় চাকরির সুবিধা আদায় করতে পেরেছিলেন। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে থেকেও অনেকেই এগিয়ে ছিলেন। শেখ ইতিসামুদ্দীন ১৭৮০ সালে তার ‘শিগুর্ফনামা-ই-বেলায়েত’ গ্রন্থে নিজেরসহ ৮ জন মুন্সির নামোল্লেখ করেছেন, যারা কলকাতায় কোম্পানির অধীনে চাকরি করতেন। ইংরেজ সিভিলিয়নদের এদেশীয় ভাষা শিক্ষাদানের জন্য ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়ম কলেজেও হিন্দুদের পাশাপাশি ৩০-৩৩ জন মুসলমান শিক্ষকতা, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় নিযুক্ত ছিলেন। ১৮১৭ সালে গঠিত ‘কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ এবং ১৮১৮ সালে গঠিত ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি’ উভয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় ৪ জন হিন্দু পন্ডিতের সাথে ৪ জন মুসলমান পন্ডিতও মনোনীত হয়েছিলেন। দেখা যায় যে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য নিয়ে যখন বাঙালি হিন্দু-মুসলমান ঊণবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করে তখনও উচ্চ শ্রেণির হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষায়, বেশ-ভূষায়, আচার-আচরণে এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ এদেশ অধিকার করার পর থেকে বিভাজনের যে পরিকল্পনা করা হয় তার বাস্তব ফলস্বরূপ উচ্চ শ্রেণির হিন্দু এবং মুসলমান নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সঠিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয় এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের বীজ রোপিত হয়। বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের নীতি বাস্তবায়ন ইতিহাসের ভিত্তি কয়েকটি কালে বিভক্ত, যথা: ১৭৬৫-১৮১৩, ১৮১৩-১৮৩৫, ১৮৩৫-১৮৫৪, ১৮৫৪-১৮৮২ এবং ১৮৮২-১৯০২ সাল পর্যন্ত।
এই কালপর্বের শেষ ধাপের চলনবিল অঞ্চলের শিক্ষার কিছু চিত্র পাওয়া যায় পন্ডিত কফিল উদ্দিন মিয়া রচিত আত্মজীবনীমূলক ‘পল্লীশিক্ষক’ নামক গ্রন্থে। বিশ শতকের শুরুর প্রাক্কালে এ অঞ্চলের শিশুদের নিজগৃহে হাতেখড়ি হতো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এক পয়সা মূল্যের ‘শিশুশিক্ষা’ প্রথম ভাগ পড়ানোর মধ্য দিয়ে। তৎকালে শিক্ষার প্রতি লোকের তেমন আগ্রহ না থাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও ছাত্র খুঁজে পাওয়া যেত না। এ কারণে চলনবিল অঞ্চলে কোনো বিদ্যালয় ছিল না। দু’একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির উদ্যোগে বাড়ির বৈঠকখানায় বা গ্রামের গ্রামের জুম্মাঘরে জনাকয়েক ছাত্র নিয়ে পড়ানো হতো। ছাত্র সংখ্যা হতো ৫ থেকে ৭ জন, স্থানবিশেষে ১০ থেকে ১২ জন। ছাত্র সংগ্রহ থেকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব শিক্ষককেই পালন করতে হতো। স্কুল পরিচালনার জন্য কোনো কমিটি ছিল না। একজন শিক্ষক একটাই স্কুল চালাতেন এবং শিক্ষকের কোনো বেতন ছিল না। শুধু ভর্তির সময় শিক্ষককে প্রত্যেক ছাত্রের অভিভাবকের পক্ষ থেকে ২ আনা ভর্তি ফি দিতে হতো যা ছিল শিক্ষকের প্রাপ্য। এইরূপ স্কুলে আরবি, বাংলা ও ধারাপাত পড়ানো হতো। তৎকালে লিখতে পড়তে জানা ব্যক্তিদের সমাজে খুব কদর ছিল এমনকি জমিদারি সেরেস্তায় চাকরিও জুটে যেত। তাদের উপরই গ্রাম্য পঞ্চায়েতের সার্বিক বিচারভার তথা
শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বর্তাতো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের অংশগ্রহণ ছিলনা বলা চলে।
১৯১৭ সালে বড়াইগ্রাম থানাকে দ্বিখন্ডিত করে একাংশ নিয়ে কুন্ডুদের দান করা একখন্ড জমির উপর গুরুদাসপুর থানার যাত্রা শুরু হয়। চাটমোহর থানার প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৪৬ সালে, বড়াইগ্রাম থানার প্রতিষ্ঠা ১৮৬৯ সালে, সিংড়া থানা প্রতিষ্ঠা ১৮৬৯ সালে, তাড়াশ থানার প্রতিষ্ঠা ১৯১৩ সালে, ভাঙ্গুড়া থানার প্রতিষ্ঠা ১৯৮১ সালে, রায়গঞ্জ থানার প্রতিষ্ঠা ১৮৪০ সালে, সলংগা থানার প্রতিষ্ঠা ২০০০ সালে এবং ১৮৭৫ সালে উল্লাপাড়া থানা প্রতিষ্ঠিত হয় । তখন গ্রামাঞ্চলে চৌকিদার ছাড়া শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কোনো বাহিনির যাতায়াত ছিল না। গ্রাম প্রধানদের সহযোগিতায় চৌকিদারেরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি মানুষের জন্ম-মৃত্যুর খবর লিপিবদ্ধ করে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত অফিসে জমা করতো। সেখান থেকে জেলা কর্মকর্তার অফিসে প্রেরণ করা হতো। লিখতে পড়তে জানা লোকদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে জমিদারি সেরেস্তায় চাকরি মিলত বলে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। এ সকল ব্যক্তিদের বৈঠকখানায় দূর-দূরান্ত থেকে আগত একজন মুন্সি, একজন চিকিৎসক, একজন শিক্ষক, দুইজন পেয়াদা ও দুইজন চাকর এবং বর্ষাকালে একজন নৌকা চালক থাকতো। বড়ো বৈঠকখানার এক অংশে পাঠশালা থাকতো। রাষ্ট্রীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ সকল স্কুল কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যেত। সেকালে ছাত্রদের ‘হাতে কাগজ দেয়া’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার সূচনা হতো। এ উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করা হতো। অক্ষর পরিচয়ের পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে মাটিতে কাঠি দিয়ে, অতঃপর স্ব্রেটপেন্সিলে লেখার অভ্যাস করতে হতো। অক্ষর পরিচয়ের পর বাড়িতে তৈরি কালি দ্বারা বাঁশের বা বনের কলমে কলাপাতা বা তালপাতায় সুন্দর করে লিখে স্কুলে গিয়ে শিক্ষককে দেখানো হতো। লেখার কালিও বাড়িতেই তৈরি হতো। মাটির পাতিল বা কড়াইয়ে ভাতের চাউল নিয়ে ভেজে পুড়িয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সুন্দর পাকা কালি তৈরি করা হতো। কলাপাতায় লেখার কালি ছিল একটু ভিন্ন রকমে তৈরি। লাউপাতায় সরিষার তেল মেখে কালো পাতিলের তলায় ঘষে অথবা প্রদীপ শিখার উপর ধরে কালো হয়ে যাওয়ার পর চিপে নিলেই চমৎকার কালি পাওয়া যেত। অক্ষর পরিচয় এবং পাতায় লেখার অভ্যাস রপ্ত করার পরই ‘হাতে কাগজ দেয়া’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খাতায় লেখার অনুমতি দেয়া হতো। ‘হাতে কাগজ দেয়া’ অনুষ্ঠানের দিন অতিথিদের উপস্থিতিতে শিক্ষক এক তা কাগজ ভাঁজ করে একখানা খাতা তৈরি করতেন, উক্ত খাতার উপর তেল সিঁদুর ও ধান দিয়ে একটি রুপার টাকায় সিঁদুর মেখে খাতার মাথায় পাশাপাশি তিনটি ছাপ দিতেন। এরপর শিক্ষক প্রথমে নিজ হাতে একপৃষ্ঠা লিখে, ছাত্রকে খাতা-কলমে সালাম করে লিখতে বলেন। কয়েক লাইন লেখার পর সবাই মিলে প্রার্থনা বা মুনাজাত করা হতো এবং খাবার পরিবেশন করা হতো। বিদায়কালে শিক্ষককে সিঁদুরমাখা রুপার টাকাটিসহ ধূতি-চাদর দিতে হতো, সবশেষে শিক্ষকসহ সকল মুরুব্বিকে পা ছুঁয়ে সালাম করা হতো এবং সবাই মাথায় হাত বুলিয়ে ছাত্রকে আশির্বাদ করতো।
সে সময় বড়াইগ্রাম থানার জোয়াড়ি ‘মধ্য ইংরেজি স্কুল’ (এম. ই) ছাড়া এ অঞ্চলে উল্লেখ করার মতো স্কুল ছিলনা। চলনবিল অঞ্চলের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক এবং রবীন্দ্র গবেষক প্রমথনাথ বিশির পরিবারের সদস্য জোয়াড়ির তৎকালীন জমিদার বাবু মোহিনী মোহন বিশি ছিলেন উক্ত মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। সে সময় জোয়াড়িতে পোস্ট অফিস, সরকারী দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পখ্যাত প্যারি মাঠানের পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জোয়াড়ি মধ্য ইংরেজি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা ছিল। স্কুল ভবনও কোনো পাকা ঘর ছিল না। একখানা আটচালা বড়ো খড়ের ঘরেই প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হতো, মাঝখানে কোনে পাটিশন ছিল না। স্কুলটিতে মোট ৬ জন শিক্ষক পাঠদান করতেন, এরমধ্যে ছিলেন ৪ জন হিন্দু ও ২ জন মুসলমান। ঘরের কোনে একটি বড়ো চৌকোনো টেবিল ঘিরে শিক্ষকেরা একসাথে বসতেন এবং ঘন্টা পড়া মাত্র সবাই নিজ নিজ শ্রেণির পাঠদান করতেন।
ছাত্রদের লেখাপড়ার প্রতি খুব চাপ ছিল। শিক্ষকেরা কড়াকড়িভাবে পড়া আদায় করতেন। পড়া না পারলে তাকে বেত্রাঘাত করা হতো, বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে ‘নিল ডাউন’ করানো হতো এবং পড়া তৈরি করে শিক্ষককে পড়া দিয়ে তবেই ছুটি মিলতো। হাতের লেখা তৈরির জন্য প্রতিদিন খুব চাপ দেওয়া হতো। ছাত্রদের প্রথম শ্রেণিতেই ইংরেজি গল্প ও কবিতা সমৃদ্ধ ‘ফার্স্ট বুক অব রিডিং’ বইসহ বেশ কয়েকখানা বই পড়তে হতো। ইংরেজি বই অনুসরণ করে ছাত্ররা আবৃত্তি এবং অভিনয় করতো, ড্রিল, পিটি এবং নিয়মিত খেলাধুলা ছিল পড়াশুনারই অংশ। দূরের ছাত্ররা জায়গির বাড়িতে থেকে প্রতিদিনের কাজ করতো এবং পড়ালেখা করতো। তৎকালে কোনো নলকূপ না থাকায় পাতকুয়া, পুকুর এবং নদীর পানিই ছিল পান করার একমাত্র অবলম্বন। জমিদার অথবা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে ইঁদারা থাকতো। সবাই ইঁদারার পানিতেই গোসল করতো, কাপড় কাচতো, থালাবাসনম ধৌত করতো এবং পান করতো। বিশি জমিদারদের বাড়িতে একটি বড়ো ইঁদারা ছিল, স্কুলের ছেলে-মেয়েরা উক্ত ইঁদারার পানি পান করতো। জমিদার বাড়িতে হাতি ছিলো, ছেলেরা হাতিতে চড়ে স্কুলে আসতো। হাতি বা পালকীই ছিল জমিদার বাড়ির লোকদের যাতায়াতের বাহন। ছেলেরা পায়ে হেটে স্কুলে যাতায়াত করতো। যাতায়াতের কোনো রাস্তা না থাকায় দূরান্তের ছেলেরা পায়ে হেঁটে, কাদামাটি মেখে, কাঁটায় অথবা শামুকে পা ক্ষতবিক্ষত করে, সাপের হাতে মৃত্যুর কথা মাথায় নিয়ে অবিশ্রাম সমস্ত দিন হেঁটে জায়গির বাড়িতে পৌঁছে স্কুলে পড়ালেখা করতো। ১৯১৭ সালে তাড়াশ থানা কাঁটাবাড়ি গ্রামের সম্ভ্রান্ত নিয়োগী পরিবার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৮ সালে চাঁচকৈড় এবং গুরুদাসপুরে দুটি এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় স্কুলে ছাত্র সংখ্যা কম হওয়ায় এবং গ্রামপ্রধানদের মধ্যে দ্ব›দ্ব নিরসনের জন্য দুটি স্কুলকে একত্র করে গুরুদাসপুর-চাঁচকৈড় এম ই স্কুল (জি সি এম ই) স্কুল নামে গুরুদাসপুরে স্কুল স্থানান্তর করা হয়। এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে মাইনর সনদ লাভ করার সুযোগ ছিল। সেকালে এতদঞ্চলে কোনো হাইস্কুল বা জুনিয়র হাইস্কুল ছিল না। খুবজীপুর গ্রামে একটি হাইস্কুল গড়ে ওঠার জন্য ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে প্রচেষ্টা অনেক পূর্ব থেকেই শুরু হয়, কিন্তু আর্থ-সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি।
খুবজীপুর গ্রামে ১৯২২ সালে প্রধানবর্গের চেষ্টায় বিদেশি সরকারের বৈঠকখানায় শ্রীপুর গ্রামের পন্ডিত কফিল উদ্দিন মিয়াকে শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে একটি পাঠশালা খোলা হয়। উক্ত পঠশালার ছাত্র ছিলেন যথাক্রমে ইদিল উদ্দিন সরকার, বরাত সরকার, কালু সরদার, দেরাজ আলী, তমেজ আলী, ডোমন মন্ডল, রেকাত আকন্দ, লাজেম সরকার, লকিমন, সবুরজান এবং অন্য দশ-বারো জন। শ্রীপুর এবং খুবজীপুর গ্রামের প্রধানবর্গের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কাইজার ফলে এক বছরের মধ্যেই স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য খুবজীপুর এবং শ্রীপুর গ্রাম দুটি দুজন ভিন্ন জমিদারের অধীন ছিল। খুবজীপুরের জমিদার ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার তাজপুরের বাবু গীরিন্দ্র প্রসাদ দত্ত, শ্রীপুরের জমিদার ছিলেন তাহেরপুরের বাবু শিব শিখরেশ্বর রায় বাহাদুর। ১৯২২ সালে খুবজীপুরে মাসব্যাপি মেলা বসে। মেলায় সার্কাস, গান-বাজনা এবং গণিকালয় স্থাপন করা হয়। এই মেলাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে মনোমালিন্য এবং দাঙ্গা শুরু হয়। মেলার পর গ্রামের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে তাজপুর এবং তাহেরপুর জমিদারের মধ্যে দ্ব›দ্ব শুরু হয়। উভয় গ্রামের বাসিন্দা এবং জমিদারের লাঠিয়ালদের মধ্যে প্রচন্ড দাঙ্গার এক পর্যায়ে শ্রীপুর গ্রামের জুরান ফকিরের ফালার আঘাতে খুবজীপুর গ্রামের লইমুদ্দিন সরকারকে গেঁথে ফেলে। শ্রীপুর গ্রামের আছের উদ্দিন কাজী ফালা টেনে বের করেন। রাজশাহী মেডিকেল স্কুল হাসপাতালে লইমুদ্দিনের মৃত্যু হলে জুরান ফকির পুলিশবাদী মামলায় বেকসুর খালাস পেলেও ফালা টেনে বের করার কারণে আছের উদ্দিন কাজীর সাত বছরের দন্ড হয়। উভয় পক্ষের ফালা, শরকি, বল্লম, লাঠির আঘাতে অনেকেই গুরুতর আহত হন। এই ঘটনার কারণে খুবজীপুর গ্রামের দত্ত জমিদার খুবজীপুর, তেঁতুলিয়া ও তেঘড়িয়ার জমিদারি বারুহাসের দেলোয়ার হোসেন খান চৌধুরীর নিকট প্রথমে দরপত্তনি এবং পরে এককালীন বিক্রয় করে দেন। মেলার পরেও নিয়মিত হাট বসতে থাকে পরবর্তী বছর কাল পর্যন্ত। কফিল উদ্দিন পন্ডিত তখন হাটের উপর অবস্থিত আটচালা ঘরে পাঠশালা শুরু করেন। কিন্তু জমিদার দেলায়ার হোসেন খান চৌধুরী হাট ভেঙ্গে দেন এবং চাঁচকৈড়ের গরীবুল্লা সরকার হাটখোলা থেকে আটচালা ঘর ভেঙ্গে চাঁচকৈড়ে নিয়ে যান। ফলত, ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিও বন্ধ হয়ে যায়। খুবজীপুর পাঠশালা উঠে যাওয়ার সময়ও বামনকোলা গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল।
১৯৩৪ শ্রীপুর গ্রামে পন্ডিত কফিল উদ্দিন মিয়ার তত্ত্বাধানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। আলেক সরকারের বাড়ির পূর্বপাশে মসজিদের স্থানে পাঠশালাটি গড়ে তোলা হয়। তিন বছর চলার পর গ্রামবাসীদের অসহযোগিতা এবং প্রধানদের দলাদলির কারণে ১৯৩৬ সালের শেষভাগে পাঠশালাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩৮ সালে খুবজীপুর গ্রামে পন্ডিত ইদিল উদ্দিনের প্রচেষ্টায় একটি নিন্ম প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় পন্ডিত কফিল উদ্দিন মিয়াকে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে ইদিল উদ্দিন সরকার এবং শ্রীপুর গ্রামের আ ফ মো মোবারক আলী মিয়া। ১৯৪২ সালে স্কুলটিকে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। ১৯৪৩ সালে খুবজীপুর উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারি মঞ্জুরী লাভ করে। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর খুবজীপুর গ্রামের বাসিন্দারা মধ্য ইংরেজি (এম ই) স্কুল করার কথা ভাবতে থাকেন। খুবজীপুর গ্রামের মরহুম বাস্তুল্লাহ সরদার বর্তমান উত্তর-পূর্ব ভবনের দুই বিঘা মূল্যবান জমি দান করেন এবং পশ্চিম পাশের এক বিঘা জমি জনৈক মামুদ আলী প্রামানিকের নিকট হতে ক্রয় করা হয়। ১৯৪৮ সালে ঐ জমিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।
খুবজীপুর এম ই স্কুলের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কাজেম উদ্দিন আহমেদ, এম এ হামিদ এবং তারাপদ বিশ্বাস। এম এ হামিদ ও কাজেম উদ্দিন রাজশাহী কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। স্বাস্থ্যগত কারণে কাজেম উদ্দিনকে চিকিৎসকের পরামর্শে পড়ালেখা বন্ধ রেখে বাড়িতে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। অগত্যা তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ না হওয়ার কারণে বিএসসি (সম্মান) শ্রেণির ছাত্র এম এ হামিদের নাম দেখিয়ে স্কুলটির মঞ্জুরী পাওয়া যায়। এম ই স্কুলের দায়িত্ব অর্পন করা হয় কাজেম উদিদন আহমদের উপর। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে স্কুলটির নামকরণ করা হয়, ‘খুবজীপুর জিন্নাহ এম ই স্কুল’। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন কাজেম উদ্দিন আহমেদ, তারাপদ বিশ্বাস, মৌলভী বাহাউদ্দিন মিয়া, মুন্সি মকবুল হোসেন ও আ. ফ. মো. মোবারক আলী মিয়া। পরবর্তীকালে মোবারক আলী মিয়া রাজশাহী থেকে ‘স্কাউট মাস্টার’ ট্রেনিং করার পর খুবজীপুর স্কুলের বয়েজ স্কাউট দলকে জেলার সেরা কাব দলে উন্নীত করেন। খুবজীপুর জিন্নাহ এম ই স্কুলের প্রধান শিক্ষক কাজেম উদ্দিন আহমদ ১৯৫০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তারাপদ বিশ্বাসের উপর। ১৯৬২ সালে খুবজীপুর এম ই স্কুলটিকে জুনিয়র হাইস্কুলে এবং ১৯৬৫ সালে হাইস্কুলে উন্নীত করা হয়। তারপর সবই ইতিহাস। গত পঞ্চাশ বছরের চলনবিল আর আজকের চলনবিলের পার্থক্য রাত আর দিন। হাজারো স্বর্ণসন্তানের জন্ম দিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, চিকিৎসা, প্রকৌশল, যোগাযোগ, অর্থনীতি, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিচয়ে চলনবিলের সবকিছু পাল্টে দিয়েছে আমাদের প্রিয় খুবজীপুর স্কুল।

Associate Professor.
Department of Folklore, University of Rajshahi.