ড. মো. আমিরুল ইসলাম


বর্ণিল সুতোয় গাথা জীবনের বয়ান
নাম তার চলনবিল। যেন এক হ্রদ। শিশু সমুদ্রও বলা যায়। পানি আর পানি। সমুদ্রের ন্যায় ক্ষুধা তার। দানও। সাদা হাতির মত তেড়ে আসে ঢেউ, আছড়ে পড়ে। দরাম দরাম ঘর ভাঙ্গে। কাত হয়ে পড়ে যায়-উপড়ে যায় গাছ। ডুবে যায় গোয়াল ঘর। কোমর পানিতে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে গরুর পাল। চিবিয়ে রস নেয় শুকনো খড়-হাওজা-ভাসমান কচুরি পানার। ভাঙতে ভাঙতে মুছে যায় উঠোন, ভিটেটুকুও। ব্যর্থ চেষ্টা চলে বাঁশ পুঁতে, চেগাড় গেড়ে, হাওজা চাপিয়ে ভিটে রক্ষার, আটকায়নাকো ঢেউ। পানি বাড়ে-সেইসাথে আমন ধানও। ডিঙ্গি একবার সাদা হাতির মতো ঢেউয়ের পিঠে ওঠে আর নামে। আছাড় খায় বারবার। ছিটা লাগে পানির- গা ভেজে- নৌকা ডোবে- মানুষ মরে। ভাসমান শাপলা দোল খায়। শাপলা-শালুক তোলে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা নৌকা বেয়ে। হাঁটতে শিখেই বৈঠা ধরে, বাবার হাতের আদর করে বানিয়ে দেয়া বৈঠা। পানিতে নামে, ঢেউ খায় ঝপাঝপ।

লাল-নীল-সাদা-হলুদ রঙের ছোটো ছোটো পালের নাও অপেক্ষা করে চরে। নিয়ে যাবে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। দিনভর নৌকা চালায়- অন্ন জোটে- ঘুম আসে শ্রমক্লান্ত মানুষের চোখের পাতায় ভর করে। ফাঁক ফাঁক গ্রাম। মেপে মেপে বসানো যেন টিলার মতো দাঁড়িয়ে বরফ সাম্রাজ্যের সাদা দিগন্তে। সবুজ পাতা মুড়ি দিয়ে স্থবির বৃদ্ধ গ্রাম। তীর্যক চাহনিতে দাঁড়িয়ে থাকে খড়ের গাদা। চকচকে দাঁতে ঝিলিক দেয় নতুন টিনের চাল। মনসার ভাসান বা মাদারের গানের আসর চলে। ঘরদোর গুছিয়ে, রান্না শেষ করে, গরুকে খইল- গুড়ো- পানি-খড় দিয়ে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ছুটে চলে বউ-ঝি-শাশুড়ি। ভীড় আর ভীড়। দোহারদের ঘিরে থাকে পাত্র-পাত্রী-অভিনেতা-পাত্র-পাত্রীদেরকে ঘিরে থাকে গোল হয়ে দর্শক-শ্রোতা-মা-বোনেরা। মেয়েদেরই প্রাধান্য এখানে। তারা তোআর হাটে-বাজারে যেতো পারে না। সিনেমা- থিয়েটার দেখার ভাগ্যও হয় না। কাজেই এ আসরের অগ্রাধিকার তাদেরই। সন্তানহীনার অন্তরে থাকে সন্তান কামনা, স্বামীর রোগমুক্তি চায় কেউবা, সংসারের অনটন থেকে মুক্তি, কেউবা চায় স্বামীর ভালোবাসা শুধু তার মনোযোগ আকর্ষণ করুক – স্বামী-সন্তান-পরিবার আর প্রতিবেশিদের সাথে সুখ আসুক গ্রাম জুড়ে এইটুকু চাওয়া।

বুড়োদের ঘিরে থাকে শিশু-কিশোর-যুবক-যুবতী। বানর বাদশার কাহিনী হবে, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, সিদ্ধির নাও, রাজকন্যার সুতোকাঁটা, মধুমালা, মদনকুমার আরও কত কথা। গুটিখেলা, একপাইতে, দুই পাইতে, ছয় পাইতে, বউতলা, টুডিং, বদন, পলানটুক, বাঘ-বকরী, হাডুডু, গোল্লাছুট, বদি বদি খেলা চলে। কাঁথার নকশায় নতুন সুতো যোগ হয়, ফুল তোলে ভাবীবধূ- ‘ভুলনা আমায়’। প্রসূতির হাতে বুরুশকাটা আর রঙিনসুতো-যাদুমনির নতুন গেঞ্জি হবে। একটা লাল সুতোর টাই আর নরম মোজা। নকশার ফোড়ন বাড়ে, ঝগড়া বাড়ে, হাসিও ছোটে। বর্ষায় তেল, নুন, হলুদ, মরিচ নিয়ে ছোটো নৌকায় ফেরি কওে দোকানীরা। শুকনো মওশুমে ঝাঁকা, চালুন, কুলা, ডালি, সরপেশ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় আসে গাওয়ালীরা। এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় যায় আরাঙ্গা বেয়ে। আরামে দাঁড়াও ভঙ্গিতে বাঁশ পুঁতে দেয়া হয় ত্যারছা করে, মাঝখানে বাঁশের পর বাঁশ জোড়া দিয়ে ফেলে , ওপরে হাতল মত কওে বাঁশ বেঁধে তৈরি হয় আরাঙ্গা। বর্ষা নেমে যায়। আল বাঁধা হয় জমিতে। ছাই-গোবর-সার দিয়ে তৈরি হয় বীজতলা। এখানে বলে কাচল। বিছন ফেলা হয়। সবুজ হয়ে ওঠে কাচল। মাটি ছোঁয়া ঘন সবুজ, কচি কচি উজ্জ্বল সবুজ। শুকোয় মাঠ। হা মুখো ফাটল ধরে কংকালের মতো। পায়ের তালু ছিদ্র হয় – চামড়া ছুঁলে যায়- নখ উল্টে যায় কৃষকের। আলবাঁধা জমিতে পানি দিলে রস পিঠার মতো শান্ত হয় মাটি। লাঙ্গল, কুষক আর বলদের সম্মিলিত চেষ্টায় তৈরি হয় থকথকে কাদা। গোছ গোছ চারা রোপন করা হয়। কাঁলি বের হয়, ছোপ হয়, ফেকাম বাড়ে। ঘাস তুলে দিয়ে সার ছিটানো হয়। সবুজের রঙ বড়ো হয়- স্বপ্ন বড়ো হয়। ধান পাকে- ঝড় আসে- শিলা পড়ে- নদীতে পানি আসে। কোচ নিয়ে বের হয় কৃষক। বোয়াল, রুই, কাতলা, মৃগেল ছটফট করে হালচেয় বাঁধা সুতোয়। খেওয়া জাল, দোরা জাল, খোড়া জাল, ধর্ম জাল, ধোর জাল, সেঁউতি জাল, বানা, ভাইর, দাউনে, সোঁতি ছেয়ে ফেলে সবদিক। শুটকীর চালান ওঠে। এখানে সবাই চাষী, সবাই জেলে, সবাই মাঝি, সবাই পাখি শিকারী। শুষ্ক মৌসুমে একমাত্র বাহন দুইপা- আর মোষের গাড়ি, গরুর গাড়ি। বোরো ধানের সীমা ছাড়িয়ে মাইলের পর মাইল ছারুখালি-বেশানির মাঠ, আশে পাশে গ্রামের চিহ্ন নেই, হাটু সমান দুবলা আর গরু, মহিষ, ভেড়ার পাল। কলাপাতায় ভাত মুড়িয়ে গামছায় বেঁধে গরুর পাল নিয়ে দূর গ্রাম থেকে আসে রাখাল বালক। খাড়ির পানিতে গরু ঝাঁপায়। গরু ইচ্ছে মতো ঘাস খায় আর ঘুড়ে বেড়ায়। রাখাল বালকেরা খেলে হাডুডু, গোল্লাছুট, ডাঙ্গুলি, গাই গোদানী। সন্ধ্যার আগেই হাঁটা দেয় গ্রামের ধুলিময় রাস্তার দিকে। শীতের সময় শুকিয়ে যায় বিল। নদীতে অল্প পানি থাকে। শুরু হয় নদী বান্ধা। পানি ঘুরে বিলে ঢোকে। খাল, জলা, খাড়ি ভরে ওঠে। সেঁওতি,  জোঁত, শ্যালো দিয়ে পানি সেচ করে কৃষক। খাড়ির পাড় জুড়ে দিগন্ত জোড়া সবুজ গম ক্ষেত। নাইওর চলে নববধূ। চোখ ছুঁয়ে যায় ভেড়ার পাল, গরুর নতুন বাছুর, মোষের ছোট্টছানা আর গমের ক্ষেত। হাজারো পাখি ওড়ে। চাকলামারা জাল নিয়ে সন্ধায় নেমে আসে এক এক অনেক দল। অজানা দুর অতীতে সেই কোন কাল থেকে এভাবেই চলে আসেছে চলনবিলের দিনলিপি। এখানে জন্ম নেয় মানুষ, মাটি ছেনে কাদা তৈরি করে, ফসল ফলায়, গান গায় তারপর একদিন চলে যায়। এই যাওয়া আসার শুরু কবে থেকে কেউ জানেনা।

আয়তন ও অবস্থান:

চলনবিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলাভূমি অঞ্চল। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা এই তিন জেলার নয়টি থানা মিলে চলনবিলের অবস্থান। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম; সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া (আংশিক) ও নবগঠিত সলঙ্গা এবং পাবনা জেলার ভাঙ্গুরা ও চাটমোহর থানা এলাকাকে বর্তমানে চলনবিল অঞ্চল নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমান চলনবিল এলাকার আয়তন প্রায় আটশ বর্গমাইল। পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩২ মাইল এবং উত্তর দক্ষিণে প্রস্থ সাড়ে ২৪ মাইল। বিলটি বিষুব রেখার ২৪০৭΄ হতে এবং ২৪০৩৫΄ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৯০১০΄ হতে ৮৯০৩৫΄ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র পাক-ভারত উপমহাদেশে চলনবিলের ন্যায় আয়তন বিশিষ্ট আর কোনো বিল আছে বলে জানা যায় না।

সীমা

চলনবিলের উত্তরে বগুড়া জেলাসীমা, দক্ষিণে পাবনা জেলার আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদী থানা, পূর্বে উল্লাপাড়া সিরাজগঞ্জ রেললাইন এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা। রানীনগর থানার পারিল ইউনিয়নের রক্তদহ বিল এককালে চলনবিলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে এটি চলনবিলের উত্তর-পশ্চিম সীমা নির্দেশ করছে।

চলনবিলের উৎপত্তি ও গঠন:

চলনবিল দোপভূমি। বাংলাদেশের অন্য যে কোনো অঞ্চলের সাথে এর ভূমি গঠনের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বিধায় সুঅতীত কাল থেকে আলোচনার অপেক্ষা রাখে। বাংলাদেশ প্রধানত নদীমাতৃক দেশ। নদী গঠনের সাথে পর্বতের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। হিমালয় এবং বঙ্গোপসাগর থেকে চলনবিলের দুরত্ব প্রায় ৩৮০ কি. মি. থেকে ৪২০ কি. মি. এর মতো। অর্থাৎ উভয় দিক থেকে দুরত্ব সমান। আর এ দেশের অধিকাংশ নদীই হিমালয় থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। হিমালয়ের উৎপত্তির ইতিহাসও আমাদের আলোচনার বাইরে নয়।

বর্তমান হিমালয় ও আল্পস পর্বত অতীতে এভাবে ছিল না। তখন এই পর্বতের স্থানে ছিল বিশাল সমুদ্র। নাম ছিল টেথিস। টেথিসের দুপাশে ছিল দুটি প্রাচীন মহাদেশ। উত্তরের মহাদেশটির নাম ছিল অঙ্গারল্যান্ড এবং দক্ষিণের মহাদেশটির নাম ছিলো গন্ডোয়ানা। অভ্যন্তরীণ শক্তিজনিত কারণে মহাদেশ দুটি পরস্পরের কাছাকাছি আসতে চাইলো। পরস্পরের প্রতি চাপ বাড়তেই থাকলো। বেচারা টেথিস মহাসাগর তখন পালিয়ে বাঁচতে চাইলো। পথ না পেয়ে নিচের দিকে বসে গেলো। পরস্পরের পার্শ্বচাপে উভয়ে মহাদেশের ক্ষয় হতে থাকলো। সংঘর্ষ বেড়েই চলল। টেথিস মহাসাগর  তখন ভূ-অভ্যন্তরস্থ সঞ্চিত পাললিক শিলারাশি উপর দিকে নির্গত করতে শুরু করল। গরম শিলারাশি আকাশ ছুঁতে চাইল। ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে পর্বতের আকার ধারণ করল। এভাবে উৎপত্তি হলো আল্পস এবং হিমালয় পর্বতের। পন্ডিতেরা ধারণা করেন পূর্ববর্তী সংঘর্ষের জের এখনও বর্তমান। তাই অঙ্গারল্যান্ড অংশ বা এশিয়া পাত এবং গন্ডোয়ানাল্যান্ড অংশ বা ভারতীয় পাত প্রতিবছর ৭-৯ কিলোমিটার এবং ১০-১৫ কিলোমিটার করে উত্তর-পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছে। ফলস্বরূপ হিমালয় পর্বত ক্রমশ উঁচু হচ্ছে।

ভূ-তত্ত¡বিদরা ধারণা করেন, গন্ডোয়ানাল্যান্ডের বয়স সম্ভবত ২২.৫ কোটি থেকে ৩৫ কোটি বছর। এই সময় থেকেই সাগর দক্ষিণ দিকে সরে আসতে থাকে এবং ভূমি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিমালয় পর্বতের উৎপত্তির পর উৎক্ষিপ্ত আগ্নেয় শিলাবাহী স্রোতধারা নিন্মগামী হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে ২২ থেকে ৭ কোটি বছর আগেকার এই মেসোজয়িক শিলারাশির তলানি, তাপ, চাপ ও হিমালয়সৃষ্ট কারণে কয়লায় রূপান্তরিত হয়।

আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া তাঁর বরেন্দ্র অঞ্চল বা রাজশাহী বিভাগের ভৌগোলিক ও ভূ-তাত্ত্বিক পরিচিতি প্রবন্ধে এ বিষয়ে চমৎকার আলোচনা উপস্থঅপন করেছেন। সমগ্র বাংলাদেশের ভূমির নিচেই রয়েছে চুনাপাথর। পন্ডিতবর্গ ধারণা পোষণ করেন যে, টেথিয়ান ভূ-আন্দোলনের ফলে হিমালয় পর্বত উচ্চতায় বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণের অতি সামান্য ও সংকীর্ণ অংশ ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ দক্ষিণ দিক হতে আগত সমুদ্র দ্বারা জলমগ্ন হয়।

হিমালয়ের বিধি জলধারা বাহিত পলল দ্বারাই বাংলাদেশের ভূমি গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের গঠনই নদীতাত্ত্বিক। চলনবিলের ভূমিরূপ ও মৃত্তিকা, বৃক্ষলতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য নদীর সাথে সম্পৃক্ত। নদীর উৎপত্তির সাথে সাথে বাংলাদেশের ভূমি কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু হয়েছে। আইনুন নিশাত এবং মনির”জ্জামান খানের ভাষায়, “বাংলাদেশেল মানচিত্রে একটি কৌতহলোদ্দীপক তথ্য রয়েছে আর তা হলো চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, ময়নামতি-লালমাই অঞ্চল, মধুপুর গড় এবং বরেন্দ্রভূমি মোটামুটি একটি কৌণিক রেখায় অবস্থিত। এদেশের অধিকাংশ নদী এসব উচ্চভূমির সংযোগহীন এলাকার সমভূমি দিয়ে প্রবাহিত। মধুপুরের পূর্বে রয়েছে সিলেটের হাওড় এবং বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে চলনবিল। ভূ-তাত্তিকদের ধারণা মতে আনুমানিক বিশ-বাইশ কোটি বৎসর পূর্বে এ অঞ্চলটি সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল। হিমালয়ের পলি জমে স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে এ ভূখন্ড। এই নদীগুলোই এদেশের প্রাণ। এরাই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমি গঠন নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেইসাথে নদীগুলোও বিভিন্ন সময় গতিপথ পরিবর্তন করে চলেছে।

উল্লেখ্য যে, মাত্র তিনশত বৎসর পূর্বে বর্তমান যমুনা নদী একটি ছোট্ট স্রোতধারায় প্রবাহিত হত। সেকালের পুরাতন ব²পুত্রই আজকের যমুনা নদী। অপরদিকে গঙ্গ নদীর নতুন শাখাই আজকের পদ্মা। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, পদ্মা ও যমুনার মধ্যবর্তী ব্যাপক এলাকা তিস্তা, করতোয়া, আত্রাই, মহানন্দা, কোশীর মতো ছোটো ছোটো নদীর বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। আইনুন নিশাত এবং মনিরুজ্জামান খান এই মতের বিরোধিতা করেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, গঙ্গার মতো বিশাল নদী অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চলটির উপর দিয়ে প্রবাহিত না হলে পুরো বরেন্দ্র এলাকাই চলনবিলের মতো নিচু ভূমিতে পূর্ণ থাকতো। বরেন্দ্রভূমি গঠনের সাথে সাথে গঙ্গ নদী দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা- চলনবিল অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকা এ কারণেই নিচু। গঙ্গা নদী দক্ষিণে সরে যাওয়ার কারণে চলনবিল এলাকার ভূমি গঠন অপূর্ণ থেকে যায়। গঙ্গা নদীর দক্ষিণমুখী প্রবাহ সম্ভবত খ্রীষ্টিয় এক হাজার বৎসর পূর্বের ঘটনা।

পূর্বে একথা বলা হয়েছে যে, হিমালয়ের জলধারা বাহিত পলল দ্বারাই বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি গঠিত। প্রায় ২.৫ কোটি বৎসর পূর্বে সমগ্র বাংলাদেশ পুনরায় সাগরতলে নিমজ্জিত হয়। কালক্রমে হিমালয় পর্বত বাহিত পললরাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উঁচু ভূমি গঠন করে । ধারণা করা হয় যে, এই পললের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০,০০০ হাজার ফুট। সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি এই পলল দ্বারাই গঠিত। বাংলাদেশের মধ্যে এই এলাকাই সর্বপ্রথম সমুদ্রের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় এ কথা অনুমান করা যায়। পরবর্তীকাল ১.২ কোটি বৎসর পূর্বে প্লাইওসিন যুগে বাংলাদেশ ভূখন্ড সমুদ্র থেকে জেগে ওঠে এবং উপমহাদেশীয় প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে এক হয়ে যায়। ভূ-তত্ত¡বিদরা মনে করেন পদ্মা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চলের নুড়ি পাথর, বালি এবং মধুপুর কাঁদা মাটি নামে পরিচিত মাটি প্লাইওসিন যুগেরই প্লাবনঘটিত অবদান। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া মত পোষণ করেন যে, বাংলাদেশের ভূমি গঠনের যে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান, তা প্লাইওসিন যুগের শেষ দিক থেকে শুরু হয়েছে। সম্ভবত ১.২ কোটি বৎসর পূর্বে সমগ্র বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে জেগে ওঠেনি। মাত্র দু’হাজার বছর পূর্বেও চলনবিল সমুদ্র গর্ভে বাস করত। বঙ্গোপসাগর যদিও তখন হিমালয় থেকে দক্ষিণে সরে এসেছে তবুও মহাস্থানগড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ধীরে ধীরে বঙ্গোপসাগর দক্ষিণে সরে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভূমির অপূর্ণ গঠন নিয়ে চলনবিল এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে থাকে। তখন সমুদ্রের সাথে সম্পর্ক শেষ প্রায়। সম্ভবত তখনও পদ্মা ও যমুনার নামকরণ হয়নি। অতীতের গঙ্গা এবং ব্র²পুত্র চলনবিলকে ঘিরে থাকতো। গঙ্গা নদীর যে স্থান হতে ভাগিরথী প্রবাহিত, তার অপেক্ষাকৃত নিন্ম পূর্বগামী শাখা পদ্মা এবং ব্রক্ষপুত্রের পশ্চিমগামী শাখা চলনবিল দিয়েই প্রবাহিত হতো। প্রমথনাথ বিশির উদ্ধৃতি দিয়ে সরদার আব্দুল হামিদ তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘চলবিলের ইতিকথা’য় বলেন- “অনুমান করলে অন্যায় হবেনা যে, চারশত বৎসর পূর্বে এই বিলটি রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে বিরাজ করত। ব্র²পুত্র ও পদ্মার সঙ্গমস্থলে পশ্চিমোত্তর অংশে চলনবিল বিরাজিত। অবস্থান, আকৃতি, প্রকৃতি দেখে চলনবিলকে উত্তর বাংলার নদনদী স্নায়ুজলের নাভিকেন্দ্র বললে অত্যুক্তি হবে না।”

নামকরণ

চলনবিলের জলরাশি কখনও স্থির ছিল না। পূর্ব থেকেই এর জলরাশি স্রোতপূর্ণ। বিলের পানি সাধারণত স্থির এবং বদ্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু আজও বর্ষাকালে চলনবিলের পানিতে অস্থির স্রোত বয়। অবশ্য এ প্রসংঙ্গে পরবর্তী অংশে আলোচনা রয়েছে। তার আগে চলনবিল নামকরণের যৌক্তিকতা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। সরদার আব্দুল হামিদ তাঁর ‘চলনবিলের ইতিকথা’য় এ প্রসংঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।  তার বইটি প্রচুর তথ্য এবং কিংবদন্তীপূর্ণ। সেখানে চলনবিলের নামকরণের সাথে চোল সমুদ্রের কথাটি এসেছে।

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতীতে সমগ্র বাংলাদেশ সাগর বাসিন্দা ছিল। এদিকে হিমালয় পলল বাহিত হয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ড ক্রমেই জাগতে থাকে এবং বঙ্গোপসাগরও দক্ষিণে পালাতে থাকে। কিন্তু অন্যান্য এলাকার ভূমি গঠন সম্পন্ন হলেও চলনবিল এলাকার ভূমি গঠন ছিল অপূর্ণ। উল্লেখ্য যে, ভূমি পূর্নগঠনের প্রক্রিয়া ২২.৫ কোটি থেকে ৩৫ কোটি বৎসর পূর্বেই শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে ২.৫ কোটি বৎসর পূর্বে বাংলাদেশ পুনরায় সাগর গর্ভে তলিয়ে যায় এবং ১.২ কোটি বৎসর পূর্বে জেগে ওঠে। এভাবে বারবার বাংলাদেশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে এবং জেগে উঠেছে। ২২.৫ কোটি থেকে ৩৫ কোটি বৎসর পূর্বের গন্ডোয়ানা যুগে বাংলার ভূমি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও চলনবিলের গঠন ছিল অপূর্ণ। কালক্রমে সমগ্র বাংলাদেশ জাগলেও চলনবিল জলমগ্ন ছিল। কারণ, ভূমি গঠনের অপূর্ণতা তষনও ছিল।

এদিকে সাগর চলেছে দক্ষিণে। কিন্তু চলনবিলের এই নিচু এলাকার সাথে যুক্ত ছিল ছোটো বড়ো বেশ কিছু নদী। নদীর সংযোগের কারণে চলনবিলের পানি সবসময় চলমান থাকতো। একদিকে বিশাল ভূ-ভাগ জলমগ্ন, অন্যদিকে সমুদ্রেরই একটা ফেলে যাওয়া অংশে তখন সমুদ্র্রের মতো স্রোতধারা বইছে। প্রাচীনকালে উরিষ্যা অঞ্চলে চোল রাজবংশ এবং চোল সমুদ্র বা Chola Lake ছিল বলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। কাজেই চোলা রাজবংশ বা Chola Lake থেকেও চলনবিলের নামকরণ হতে পারে। চোল রাজবংশ সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত রাজত্ব করত। তাদের ছিল শক্তিশালী নৌসেনা। আমরা আগেই জেনেছি সমগ্র মহাস্থানগড় পর্যন্ত অঞ্চল সাগরে নিমজ্জিত ছিল।

আজকের চলবিল আর অতীতের চলনবিলের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কারণ, অতীতে চলনবিল অনেক বিস্তৃত ছিল। ইতিমধ্যে আমরা প্রমথনাশ বিশীর উদ্ধৃতি থেকে তা জেনেছি। কাজেই তৎকালীন চলনবিলকে ‘চোল সমুদ্র’ বলতে দোষের কিছু দেখিনা। কারণ সমুদ্রেরই একটি অংশ চলনবিল। হিমালয়ের উৎপত্তিজনিত শিলাময় ভস্মরাশির জলধারা বাহিত পলল যদি চলনবিল এলাকা দিয়ে গন্ডোয়ানা যুগে বাহিত হতো তাহলে আজকের চলনবিলের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতনা। এখানে গড়ে উঠত পর্বত মহাপর্বত। আজ চলনবিল অনেক ছোটো হয়ে গেছে, কিন্তু বর্ষাকালে চলবিল উগ্রমূর্তি ধারণ করে। নদী,খাল, জোলা, খাড়িসমূহ চলনবিলকে এমনভাবে বেঁধে আছে যে, স্বাভাবিকভাবেই বর্ষাকালে এর জলরাশিতে স্রোত বয়। আর এই স্রোতের চলমানতার কারণেই চলনবিল নামকরণ করা হয়েছে- এ তথ্যটিও বেশ যুক্তিসঙ্গত। খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দীর মানচিত্রে আছে – উত্তরে মহাস্থানগড়, দক্ষিণে ঢাকার  বিক্রমপুর ও চট্টগ্রাম ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ জলমগ্ন। চীনদেশীয় পর্যটক সিউয়েন সাঙ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারত এসে চৌদ্দ বৎসর অবস্থান করেন। তাঁর লিখিত বিবরণ থেকে ধারণা করা হয় যে, সপ্তম শতাব্দীতে চলনবিল গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থান করতো। উল্লেখ্য যে, তিনি পুন্ড্রুবর্ধন হতে বিরাট নদী অতিক্রম করে আসামের কামরুপ রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন। “ From Pundravardhan … proceed for 900 li or 150 miles to the east and crossing a great river, kimleupo or kamrup.”

চলনবিলের ভূমি নরম, পিচ্ছিল ও কাদাময়। যাকে নিরেট পলি মাটিও বলা হয়। কালে কালে পলি জমে জমে এর ভূ-ভাগ গঠিত হয়। পাথুরে পাললিকের পরিবর্তে প্লাবিত পলি মাটিতে চলনবিলের গন্ডোয়ানা যুগের অপূর্ণতা ভরাট হতে থাকে। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু উর্বর পলিমাটির এই ভূপৃষ্ঠ ক্রমেই মানুষের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

উল্লেখ্য যে, গঙ্গা নদীর উজানে ভারত যদি ফারাক্কা বাঁধ তৈরি না করতো তাহলে চলনবিলের কোন অংশই নিচু থাকতো না। কারণ, পলিমাটির স্তরে ভরে যেত চলনবিলের নিচু এলাকা। ফলত চলনবিল হতো আরও উর্বর শস্যপ্রসবা। ফারাক্কা বাঁধের কারণেই চলনবিল বর্ষা মৌসুমে ভাসিয়ে নেয় সবকিছু, আবার শুষ্ক মৌসুমে উঁচু এলাকা মরুভূমির আকার ধারণ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলের রেভিনিউ সার্ভে নক্সায় উত্তর পশ্চিমে কলম, দক্ষিণ পশ্চিমে গুনাইগাছী, পূর্বে হান্ডিয়াল ও তাড়াশ প্রভৃতি অল্পসংখ্যক গ্রাম এবং মাঝখানে চলনবিলের অংশবিশেষ এবং তাড়াশ থানার নওগাঁ শাহী মসজিদ দৃশ্যমান। ১৮৮৫ সালের প্রকাশিত Mr. E. Balfour সংকলিত ‘Cyclopeadia of India’ Vol:3, Page- 355 তে বলা হয়েছে “ Towards the east, the marshes increase in number and size untill they merge in the great Chalanbeel on the district boundary … Chalanbeel is in fact, a great reservoir of hte surplus water supply of the whole surrounding country. It has connections with the rivers and water courses, which here lose their identity and during the rains it swells till it covers a total area of about 120 square miles.”

১৯১৯ সালের ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়ার পাবান অংশে উল্লেখ করা হয়েছে- “ The only sheets of the water which can be called lakes are The Chalanbeel, which covers large portion of the regions and Chatmohor thanas.”

পন্ডিতগণ ধারণা করেন খ্রীষ্টিয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের উঁচু এলাকসমূহের বসতি শুরু হয়। যুক্তিস্বরূপ তারা বড়াইগ্রাম থানার ধানাইদহ গ্রামের চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর গুপ্ত রাজা কুমার গুপ্তের তাম্রশাসন প্রাপ্তির কথা বলেন। এই তাম্রশাসন পাওয়ার পর পন্ডিতবর্গ আরও জোরাল যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। তারা মনে করেন, চলনবিলের দক্ষিণ অংশ বিশেষ করে বড়াইগ্রাম ও চাটমোহর থানা অনেক পূর্ব থেকেই বাসোপযোগী ছিল। অপরদিকে রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া এবং তাড়াশ থানার উত্তর প্রান্তে সেন রাজত্বকালে বেশকিছু গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়। তাড়াশ থানার অন্তর্গত মাধাইনগর গ্রামে সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেনের একখানি তা¤্রশাসন পাওয়া গেছে।