ড. মো. আমিরুল ইসলাম ইসলামি মরমিবাদকে তাসাউফ বা সুফিতত্ত্ব বলা হয়। সুফিবাদ ইসলামি দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি ইসলামের অন্তর্নিহিত ও অতি সূক্ষ্ম দিক। এই অন্তর্নিহিত ও সূক্ষ্ম দিক বাদ দিয়ে বাইরের দিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম পূর্ণতা পায় না। পৃথিবীর সকল ধর্মেই প্রাতিষ্ঠানিকতার পাশাপাশি মরমিবাদের মিশ্রণ ঘটতে দেখা যায়। এইসব ধর্মের আবহে এমন একদল লোকের আবির্ভাব...
" />ইসলামি মরমিবাদকে তাসাউফ বা সুফিতত্ত্ব বলা হয়। সুফিবাদ ইসলামি দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি ইসলামের অন্তর্নিহিত ও অতি সূক্ষ্ম দিক। এই অন্তর্নিহিত ও সূক্ষ্ম দিক বাদ দিয়ে বাইরের দিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম পূর্ণতা পায় না। পৃথিবীর সকল ধর্মেই প্রাতিষ্ঠানিকতার পাশাপাশি মরমিবাদের মিশ্রণ ঘটতে দেখা যায়। এইসব ধর্মের আবহে এমন একদল লোকের আবির্ভাব ঘটে, যারা হৃদয়ের অনুভূতি দ্বারা আত্মসত্ত্বাকে লীন করে পরম সত্ত্বার সাথে মিলিত হতে চান। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরব দেশে ইসলামের আবির্ভাব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ইসলামের সংস্পর্শে আসে। তবে অষ্টম শতাব্দীর পূর্বে বাংলাদেশের সাথে ইসলামের কেন্দ্রস্থান আরব দেশসমূহের কোনো প্রকার বাণিজ্যিক বা ধর্মীয় ভাব বিনিময় হয়েছিল বলে জানা যায় না। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে আরব দেশসমূহের সাথে বণিকদের মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ হয়। বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে আরব বণিকদের ব্যবসায়ীক তৎপরতার ফলে এদেশে প্রথমিকভাবে ইসলামিক ধ্যান ধ্যারণার বিস্তৃতি ঘটে।
১২০১ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির গৌর অধিকারের পর থেকে এদেশে ইসলাম ধর্ম দ্রুত প্রচার লাভ করে এবং সুফিবাদী ধারণার বিকাশের পথ সুগম হয়। তিব্বত অভিযানকালে তিনি কোচ রাজাকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত করে তার নাম দেন আলী মেচ এবং এই আলী মেচই সুলতানকে পথ দেখিয়েছিলেন। অন্যান্য মুসলমান শাসক, যেমন, হুসাম উদ্দীন (১২১২-১২২৬), নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ (১২২৬-২১২৮), রুকনুদ্দীন বারবাক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) প্রমুখ এদেশে ইসলাম প্রচারে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁদের ধর্মপ্রীতির ফলে আরব-পারস্য-বাগদাদ প্রভৃতি স্থান হতে বহু সুফি-দরবেশ এদেশে আসেন এবং ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই এদেশ সুফিদের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। মধ্যযুগের বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাস পাঠে জানা যায় আরব, ইরাক, ইরান, তুর্কিস্তান, আফগানিস্থান প্রভৃতি অঞ্চল হতে আগত মুসলিম বণিক, সুফি-দরবেশ ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে ইসলামিক ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে। এসব সুফি সাধকদের জীবন-প্রণালী ছিল আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয়। আচার-আচরণে ও পোষাক-পরিচ্ছদে এরা ছিলেন অতি সাধারণ ও বিনয়ী। সুফিদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবন-দর্শনের প্রতি এদেশীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-অন্ত্যজ শ্রেণী আকৃষ্ট হন। বাংলায় ইসলাম পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই নিম্ন বর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এখানে হিন্দুরা ছিলেন রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে; বৌদ্ধরা ছিলেন তাদের কাছে নিগৃহীত। বর্ণবাদী হিন্দু সমাজে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ব্রাহ্মণগণ। নিম্ন বর্গের শুদ্র শ্রেণী সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে নিগৃহীত ছিলেন। মন্দিরে প্রবেশ এমনকি ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ ও স্পর্শ করার অধিকারও তাদের ছিলনা। সেকালে বৌদ্ধদের প্রতিও হিন্দুদের আচরণ ছিল বরাবরই বৈষম্যমূলক। ফলে এদেশের সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রসারের পেছনে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দী হতে পনের শতাব্দী পর্যন্ত এদেশে বিভিন্ন তরিকাপন্থী সুফি-দরবেশের আগমণ ঘটে। পনের শতাব্দীর পর হতে একদিকে যেমন ইসলামিক তত্ত¡ধারার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে, তেমনি এতে দেশজ ধ্যান-ধ্যারণা এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। আদি ইসলামিক তত্ত¡ধারা বিশেষ করে সুফিতত্ত¡ এবং দেশজ তান্ত্রিক, যোগ ও বিভিন্ন বৈরাগ্যবাদী ভাবধারার সংমিশ্রণে যে নতুন ভাবধারার উন্মেষ ঘটে, তাকে ‘লৌকিক ইসলাম’ (Popular Islam) বা নব্যসুফিবাদ বলে মুহম্মদ এনামুল হক প্রমুখ পণ্ডিতগন আখ্যায়িত করেন । রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছত্রছায়ায় পির-দরবেশ-ওলি-আওলিয়াগণ স্বাধীনভাবে ইসলামের বাণী ও রীতি-নীতি প্রচার করেন। তাদের চারিত্রিক-মাহাত্ম্য, আত্মত্যাগ, মানবসেবা ও ধর্মনিষ্ঠায় দলিত জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ আকৃষ্ট হন এবং নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতার বলয়ে থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় চারপাশে সমবেত হন। বাংলায় সুফিবাদের বিকাশে মুসলমান সুফিদের মধ্যে মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতান হাসানী মাদিয়া বুরহানা ছিলেন বুরহানা মিশ্র স¤প্রদায়ের প্রধান শিক্ষাগুরুদের অন্যতম। মুঘল সুলতান শাহ সুজা সাধু ফকিরদেরকে খুব সম্মানের চোখে দেখতেন এবং তিনি একটি সনদে এই মাদারিয়া গুরুকে কয়েকটি বিশেষ সুযোগ-সুবিধা মঞ্জুর করেন। শাহ সুলতান হাসানী মাদিয়া বুরহানা এই সনদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে শাহজাদা সুজা ফকিরদের জন্য যে সনদ জারি করেন তাতে উলে¬খ ছিলো: ‘প্রথমত, তারা (ফকিরগণ) নিজেদের খুশি অনুযায়ী যেকোনো দেশ, বিভাগ বা শহরে গমণাগমন করতে পারবেন এবং ‘জুলুস’ এর জন্য বিভিন্ন সামগ্রী যথা Ñ প্রতীকচিহ্ন, পতাকা, খুঁটি, খাদ্যবস্তু, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি বহন করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, তারা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার পতিতজমি, মালিক বিহীন জমি বা করমুক্ত জমিজমা নিজেদের খুশি মতো ভোগ দখল করতে পারবেন। তৃতীয়ত, কোনো প্রকার খাজনা তাদের ওপর ধার্য থাকবে না।’
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার সুফি-দরবেশদের দ্বারাই মূলত দ্রুত প্রসার লাভ করে। দেশজ মুসলিমরা পূর্ব পুরুষের আচার-সংস্কার কাক্সিক্ষত মাত্রায় ভুলতে পারেননি। কাজেই সুফিতত্তে¡র যে কিছুতে সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখেছেন, তারা তাই গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই বৌদ্ধ নাথপন্থ, সহজাত তান্ত্রিক সাধনা, যোগ-কায়-সাধনা, শাক্ততন্ত্র, বামাচারী সাধনা প্রভৃতি তাদের চর্চার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এভাবে তারাও স্বদেশে খাড়া করেছেন মিশ্র দর্শন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাই বলেন, ’সুফি মতের ইসলাম সহজেই বাঙ্গালার প্রচলিত যোগ মার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধন মার্গের সঙ্গে একটি আপোষ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।’ আহমদ শরীফের মতে বাংলাদেশে চৌদ্দটি গুরুবাদী খান্দান বা স¤প্রদায় প্রখ্যাত হলেও উপশাখাও ছিল অনেক। বহিরাগত কাদেরিয়া, সুহরাওয়ার্দিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ছাড়াও দেশজ কলন্দরিয়া, মাদারিয়া, গাওয়াতমিয়া, নিজামিয়া প্রভৃতি সুফিমত ও জনপ্রিয় ছিল। সুফিরা যুক্তিবাদী, বিশ্লেষণধর্মী এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত নন; তারা চান হৃদয়ের অনুভুতির গভীরতা ও নিবিড়তার মাধ্যমে পরম প্রেমানন্দের সান্নিধ্য। তারা চান পরম সত্তার সাথে মিলনের অমৃত পান করে মৃত্যুঞ্জয় হতে। পরবর্তীকালে বাংলার সুফিগণ হিন্দু যোগী ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সাথে আরও নিকটতর সম্পর্কে যুক্ত হন। প্রাথমিক পর্বে হিন্দু সমাজে বৈষ্ণববাদ এবং এরূপ অন্যান্য অতীন্দ্রিয় পদ্ধতির সংযোগ ঘটে। কিন্তু পরবর্তী পর্বে মুসলমান অতীন্দ্রিয়বাদীদের ওপর ধীরে ধীরে যোগবাদ ও বৈষ্ণববাদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিককার মুসলমান সুফি পণ্ডিতগণ হিন্দু-ধর্ম-দর্শন এবং তাদের তান্ত্রিকতা ও যোগবাদ সম্পর্কে জ্ঞানলাভের জন্য উৎসুক ছিলেন। এই কারণে দেখা যায় যে, বাংলা জয়ের কয়েক বছর পরে ল²ণাবতীর মুসলমান পণ্ডিতগণ হিন্দু দর্শন ও অতীন্দ্রিয়বাদের সাথে পরিচিত হন। এ সময় ‘অমৃতকাণ্ড’ নামে লিখিত হিন্দু যোগবাদের ওপর একখানা গ্রন্থ জনৈক বাহ্মণ যোগী পণ্ডিতের সহায়তায় মূল সংস্কৃত থেকে আরবি ও ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে মুসলমান সুফিগণ হিন্দু দর্শন ও অতীন্দ্রিয়বাদের সঙ্গে পরিচিত হন। হিন্দু যোগীদের সংস্পর্শে মুসলমান সুফিগণ আরও কিছু বাহ্যিক রীতি-নীতি গ্রহণ করেন এবং এগুলোকে এক ও অভিন্নরূপে বাঙালির জীবনের সাথে যুক্ত করেন। আর এভাবেই বাঙালির জীবনে নতুন রূপে সুফিবাদ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের প্রবর্তনের ফলে হিন্দু সমাজে একটি সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সমসাময়িক সাহিত্যে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। মুসলমান শাসনকর্তাদের সভাসদ ও রাজকর্মচারী হিসেবে অথবা মুসলিম জনগণের প্রতিবেশিরূপে হিন্দুরা মুসলমানদের সংস্পর্শে আসেন। আনন্দ-উৎসবের সময় হিন্দু অভিজাত ব্যক্তিগণ মুসলমানদের ন্যায় পোশাক পড়তেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় মুহাম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী’ কাব্যের নায়ক, যুবরাজ মনোহর পাগরীও ঢিলা জামা (কাবাই) পরিধান করেন, যা ছিলো মুসলমানদের বিশিষ্ট পোশাক। কবি কৃত্তিবাস, বিজয়গুপ্ত ও বৃন্দাবন দাসের বর্ণনায় হিন্দু রমণীদেরকে মুসলমানী পোশাকে তুলে ধরা হয়েছে। তারা ঘাঘরা, ওড়না এবং কাঁচুলি বা চোলি ব্যবহার করতেন। ড. দীনেশ সেন মন্তব্য করেন যে, মুসলমান আমলে হিন্দু রাজন্যবর্গ ও জমিদারগণ মুসলিম অভিজাত ব্যক্তিগণের মতো পোশাক-আশাক ধারণ করতেন এবং তারা কেবল কপালে চন্দন ফোঁটা ও উৎসর্গীকৃত চিতাভস্মের দ্বারা চিহ্নিত হতেন। বিদ্যোৎসাহী মুসলমান সুলতানগণ বিদ্বান ব্যক্তিদের সাহচর্য পছন্দ করতেন। সুতরাং তারা তাদের রাজসভায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও হিন্দু বিদ্বান ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাতেন। কুলীন ব্রাহ্মণগণ মুসলমানদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের এ ধরনের মেলামেশা বরদাশত করতে পারেন নাই। কুলীন ব্রাহ্মণেরা এই কারণে তাদের সে স্বধর্মীদেরকে সমাজচ্যুত করেন। এভাবে হিন্দু সমাজে ব্রা²ণদের মধ্যে কয়েকটি সমাজচ্যুত দলের উদ্ভব ঘটে। এদের মধ্যে বাঙালি সমাজে শেরখালী ব্রাহ্মণ, পিরালী ব্রাহ্মণ ও শ্রীমন্তখানী ব্রাহ্মণেরা সুপরিচিত ছিলেন। উলেখ্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুর্বপুরুষ পীরালী ব্রাহ্মণ ছিলেন। ধর্মপূজা নামে পরিচিত একটি লৌকিক ধর্মীয় বিশ্বাস হিন্দু সমাজের ওপর মুসলমান প্রভাবের একটি নির্ভুল প্রমাণ বহন করে। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তাৎপর্যপূর্ণ সত্য এই যে, এরা একেশ্বরবাদ নীতিতে বিশ্বাসী এবং ধর্মঠাকুর নামে অভিহিত একেশ্বরের পূজার অনুসারী। এরা সকল মানুষের সাম্যের আদর্শকে স্বীকৃতি দেন এবং হিন্দু সমাজে বর্ণ বৈষম্যের বিরোধিতা করেন।
বাংলার ধর্মপূজা পদ্ধতির উৎস সন্ধান করলে জানা যায় যে, ‘মন্ত্রযান’ অথবা সাধারণভাবে ‘বজ্রযান’ নামে পরিচিত তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের কিছু উপাদান থেকে এবং তান্ত্রিক হিন্দুমতের (শৈব ধর্ম) কিছু প্রথা পদ্ধতি থেকে ধর্মপূজা পদ্ধতির উদ্ভব। বাংলাদেশে হিন্দু আমলের শেষভাগে মহাযান বৌদ্ধমত হিন্দু তান্ত্রিকদের কিছু ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি এবং মিশ্র লৌকিক বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। নাথ ধর্মের মধ্যে প্রকাশ পায় কিভাবে পরবর্তীকালের বৌদ্ধধর্ম হিন্দু তান্ত্রিক কিছু উপাদান গ্রহণ করে। ‘ধর্মপূজা বিধান’ নামে অভিহিত ‘শুন্যপুরাণ’ কাব্যে ধর্মপূজা পদ্ধতির উৎপত্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। ধর্মপূজার প্রতিষ্ঠাতা রামাই পণ্ডিত একজন ব্রাহ্মণছিলেন। অতি অল্প বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। তিনি সময়মতো পিতার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করতে না পারায় গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ তাকে জাতিচ্যুত করেন। কোনো ব্রাহ্মণপুরোহিতই তার পৈতা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে আসেন নাই। তার প্রার্থনায় ধর্মঠাকুর একজন বৃদ্ধ ব্রা²ণের ছদ্মবেশে আগমণ করেন এবং তাকে একটি তাম্র পৈতা দান করেন। তিনিই রামাই পণ্ডিতকে ধর্মপূজার আদর্শে দীক্ষিত করেন। শূন্যপূরাণে ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ বলে একটি অংশ আছে। এই অংশ থেকেই শূন্যপূরাণ ও ধর্মঠাকুরের সঙ্গে ইসলামের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জানা যায় জাজপুর ও মালদহে সদ্ধর্ধীরা দ্বিজগণ কর্তৃক বিনষ্ট হচ্ছিল। ‘ই বড় হইল অনাচার’। তখন ধর্মকে তারা ডাকলেন ‘সভে বলে রাখ ধর্ম’ অন্তর্যামী বৈকুণ্ঠপতি ধর্ম সমস্ত দেবদেবী সহ ভক্তকে রক্ষা করতে যবনরূপে অবতীর্ণ হলেন। শূন্যপূরাণের ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ অংশ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। যথা:
‘জাজপুর পুরবাদি/ সোলসঅ ঘর বেদি/ বেদি লয় কন্নয় যুন/ দখিন্যা মাগিতে যাঅ/ জার ঘরে নাহি পাঅ/ সাঁপ দিয়া পুড়াএ ভুবন/ধর্ম্ম হৈল্যা জবনরুপি/ মাথাএত কাল টুপি/ হাতে সোভে ত্রিরূচ কামান/ চাপিআ উত্তম হয়/ ত্রিভুবনে লাগে ভয়/ খোদায় বলিয়া এক নাম/ নিরঞ্জন নিরাকার/ হৈলা ভেস্ত অবতার/ মুখেতে বলেত দম্বদার (দম মাদার)।’
বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারাবাহিকতায় লৌকিক দেব-দেবীর আদলে মুসলমান সমাজে কল্পিত অথবা পূজিত পিরকে নিয়ে যে মৌখিক কাব্যধারা গড়ে ওঠে তা বাংলার সুফিবাদেরই ফসল। বিবিধ পালা ও কাহিনি-উপকাহিনির সমন্বয়ে বিরুদ্ধ বা প্রতিকূলতাকে জয় করে অনুকূল জীবনের পথে অগ্রসর হওয়ার যে দৃঢ় চেতনা, এর অনুশীলন এবং আদর্শ ফুটে ওঠে এ সকল মৌখিক কাব্যধারা এবং সাহিত্যে। জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র আত্তীকরণের মাধ্যমে বাঙালির সঙ্গে উত্তর-ভারতীয় ভাষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার পরিচয় ঘটে। বাঙালি বিদেশি ধর্ম গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু কোনো ধর্মই সে অবিকৃত রাখেনি। বৌদ্ধ চৈত্য হয়ে ওঠে অসংখ্য দেবতার আখড়া। জৈন ধর্ম পরিত্যক্ত হয়, ব্রাহ্মণ্য ধর্মও বহু স্থাণিক দেবতার চাপে পড়ে যায়। মুসলমান সম্প্রদায় পিরপূজায় অভ্যস্ত হয়। পরবর্তীকালে হিন্দু দেব-দেবীর অনুকরণে মুসলমান সমাজে সুফিসাধক পিরদের মাহাত্ম্যসূচক গাথা, গীত এবং পালাগান মুখে মুখে প্রচারিত হয়। মৌখিকভাবে প্রচারিত এই সাহিত্য বাংলার পিরসাহিত্য নামে পরিচিত। ঐহিক জীবনবাদী বাঙালির সুফিবাদে সে কথারই প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
nice post. thank you