১. প্রাক কথন বিখ্যাত জার্মান আইডিওলজি (১৮৪৫-৪৬) গ্রন্থের একটি অনুচ্ছেদে মার্কস-এঙ্গেলস’র ভাষ্য অনেকটা এরকম, ‘ভাবনা, ধারণা ও চেতনার উন্মেষ প্রথমত সরাসরি যুক্ত হয়ে রয়েছে মানুষের সাথে তার বাস্তবের আদান-প্রদানÑ প্রকৃত জীবনের ভাষায়। ধারণা করা, চিন্তা করার মতো মানুষের আত্মিক আদান-প্রদানও সম্ভবত স্বতোৎসারিত হয় মানুষের এই বাস্তব আচরণ থেকেই… রক্তমাংসের মানুষকে বোঝবার জন্য আমরা মানুষের বক্তব্য,...
" />১. প্রাক কথন
বিখ্যাত জার্মান আইডিওলজি (১৮৪৫-৪৬) গ্রন্থের একটি অনুচ্ছেদে মার্কস-এঙ্গেলস’র ভাষ্য অনেকটা এরকম, ‘ভাবনা, ধারণা ও চেতনার উন্মেষ প্রথমত সরাসরি যুক্ত হয়ে রয়েছে মানুষের সাথে তার বাস্তবের আদান-প্রদানÑ প্রকৃত জীবনের ভাষায়। ধারণা করা, চিন্তা করার মতো মানুষের আত্মিক আদান-প্রদানও সম্ভবত স্বতোৎসারিত হয় মানুষের এই বাস্তব আচরণ থেকেই… রক্তমাংসের মানুষকে বোঝবার জন্য আমরা মানুষের বক্তব্য, কল্পনা, ভাবনা বা মানুষকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ভাবা হয়েছে, কল্পনা করা হয়েছে, তার কোনোটা থেকেই শুরু করি না, বরং আমরা সরাসরি বাস্তব সক্রিয় মানুষ থেকেই শুরু করি… চেতনা জীবন নির্ধারণ করে না, জীবন চেতনাকে নির্ধারণ করে।’ এই উক্তির শেষ কথাটি দিয়েই বাংলাদেশের ভিক্ষুকের গানের অনুসন্ধানে উপলব্ধ অনুভূতির বীক্ষণে উপরোক্ত শিরোনামে প্রবন্ধের অবতারণা। অতীতের আর্থকাঠামো ও ধর্মব্যবস্থার দ্বারা বাংলাদেশের সমাজ খুব বেশি পরিমাণে প্রভাবিত। এদেশের জীবনধারা প্রকৃতি নির্ভর হলেও অর্থনৈকি- রাজনৈতিক উপাদানগুলোর বাস্তব বিষয়াদি খুব বেশি পরিমাণে জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব বিস্তার করায় সামাজিক বৈষম্যের মাত্রা চরম রূপ লাভ করেছে। আর এই বৈষম্যে থেকেই জন্মলাভ করেছে ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিন্দনীয় অথচ অনিবার্য পেশা। বিশেষ কোনো পেশা বা নৈতিকতার বিচারে বৃত্তি হিসেবে সমর্থিত না হলেও ভিক্ষাবৃত্তি শব্দটি অধিকতর প্রচলিত থাকায় বর্তমান প্রবন্ধে ভিক্ষাবৃত্তি শব্দটিই প্রয়োগ করা হলো। বিষয়ের বিস্তারের সাথে বলে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান প্রবন্ধটি ভিক্ষাবৃত্তি বা মাঙনের গান নিয়ে রচিত হওয়ার কারণে ভিক্ষাবৃত্তির বিস্তারের বিষটি ঐতিহাসিক-সামাজিক বাংলার সমাজ কাঠামোর বিচারে আলোচনায় প্রাধান্য পেলেও লক্ষ থাকবে গানের দিকে।
২. ভিক্ষুকের গানের প্রকরণগত স্থান
বাংলাদেশে লোকসঙ্গীতের দুটি বিশেষ ধারা। যথা:
১. লোকধর্ম বা লৌকিক অধ্যাত্ম চেতনাপুষ্ট সাধন সঙ্গীত।
২. লৌকিক জীবননির্ভর সাধারণ সঙ্গীত।
বাংলাদেশের ভিক্ষুকের গান এই বিবেচনায় দ্বিতীয় প্রকরণের অর্ন্তভুক্ত হলেও গানের বিষয়বস্তু প্রথম প্রকরণের সাথেই বেশি মানানসই। অর্থাৎ, মাঙন বা ভিক্ষার জন্য যে সকল গান গাওয়া হয়ে থাকে সেগুলো লোকধর্ম বা লৌকিক অধ্যাত্ম চেতনাপুষ্টই কেবল নয়; ক্ষেত্রবিশেষে নৈতিক বা ধর্মীয় বিষয়াদিই সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। অপর দিকে লক্ষ রাখতে হবে যে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে যুক্ত সংগীতগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। অর্থাৎ, মানুষ যে ধরনের গানে আকৃষ্ট হয় সে ধরনের গান পরিবেশন করেই অর্থসাহায্য লাভের চেষ্টা থাকে গায়কের। ক্ষেত্রবিশেষে, বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবির গান, আধুনিক ও জনপ্রিয় বাংলা গান, প্রচলিত ও অধিকতর জনপ্রিয় লোকসংগীত প্রভৃতিও গীত হতে দেখা যায়। বর্তমান প্রবন্ধের মৌলিকতার স্বার্থে এ ধরনের গানগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। প্রতিটি লোকসঙ্গীতের যেমন ভৌগোলিক পরিম-ল রয়েছে, তেমনি অঞ্চলবিশেষে লোকসঙ্গীতের নির্দিষ্ট কাঠামোও গড়ে ওঠে। ভাব, ভাষা, এমনকি গায়কী বা গায়নশৈলীও প্রতিটি গানের আঞ্চলিক ভূগোলের উপরে অনেকটা নির্ভরশীল। এখানে উল্লেখ্য যে, ভিক্ষাজীবীদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হলেও তাদের গীত গানের কথা এবং উচ্চারণে নিজ নিজ এলাকার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। কোনো একটি লোকসঙ্গীত একটি বিশেষ অঞ্চলে রচিত হলেও লোকশিল্পীদের মাধ্যমে তার পরিবর্তন ঘটে, সুর এবং বাণীতেও ঘটে নানা ধরনের সংযোজন-বিয়োযোজন। বক্ষমান প্রবন্ধের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে বর্তমান বাংলাদেশের নাটোর, রাজশাহী এবং সিরাজগঞ্জ জেলার কিছুসংখ্যক হাঁট-বাজার, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, আদালত প্রাঙ্গণ প্রভৃতি জনবহুল স্থানে ক্ষেত্রসমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে।
৩. লোকসংগীত হিসেবে ভিক্ষুকের গান: ঐতিহাসিক বিবেচনা
ভিক্ষুকের গানের বর্তমান এবং অতীত কাঠামো এক নয়। ভিক্ষাবৃত্তি যে কোনো সমাজের জন্য একটি নিন্দনীয় দিকই শুধু নয়, সেই সমাজের দারিদ্র্যের চেহারাও প্রকাশ করে। কিন্তু অতীত ইতিহাসে চোখ মেলে আমরা দেখতে পাই যে, ভিক্ষাবৃত্তির সাথে সামাজিক শিক্ষা এবং সহিষ্ণুতার পরীক্ষার প্রস্তুতি বা অনুশীলনের দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। প্রাচীন বাংলার বিহার বা সংঘসমূহে যে সকল বঙ্গ সন্তানেরা বিদ্যা চর্চা করতেন, তাদের শিক্ষার একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ ছিল বিনয় অর্জন। গুরুগৃহ বা সংঘে বসে বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি জাগতিক সকল বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হতো, পরিপূর্ণ জ্ঞান দান শেষে ভিক্ষার পাত্র হাতে তুলে দেওয়া হতো। নগর বা পুরের দ¦ারে দ্বারে ঘুরে তাদেরকে ভিক্ষা মাগতে হতো। এই ভিক্ষা মাগার উদ্দেশ্য যতটা ছিল ভিক্ষাপ্রাপ্তি, তার অধিক ধৈর্য্য ও বিনয়ের অনুশীলন। কেউ ভিক্ষা না দিলে বা কর্কশ ভাষায় তিরষ্কার কিংবা লাঞ্ছিত করলে; ধৈর্য্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, বিনয় দিয়ে পরিস্থিতিকে জয় করাই ছিল ভিক্ষার উদ্দেশ্য। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, বাংলার লোককাহিনি ও পালাগানে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই যে, সাধু-সন্ন্যাসীগণ ভিক্ষার পাত্র নিয়ে সশিষ্য বেড়িয়েছেন, কিংবা শিষ্য ভিক্ষার পাত্র নিয়ে বেড়িয়েছেন গুরুকে তুষ্ট করবেন বলে। কাজেই ভিক্ষাবৃত্তি বাঙালির অতীত জীবনে বিনয় শিক্ষা অনুশীলনের অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যার পদগুলিও ভিক্ষার সময় গীত হতো। কাজেই বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভিক্ষুকের গান হিসেবে চর্যার পদগুলিকে উল্লেখ করা যায়। প-িত রাহুল সাংকৃত্যায়ন নেপালের রাস্তায় সন্ন্যাসীদের মুখে মুখে চর্যার পদসমূহ গীত অবস্থায় ভিক্ষা করতে দেখেছিলেন, বিশ শতকের প্রথম দশকেও।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও ভিক্ষাবৃত্তি বিস্তারের ক্ষেত্রে কালের প্রভাবক হিসেবে কয়েকটি ধাপকে মোটামুটি সুনির্দিষ্ট করা যেতে পারে:
১. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
২. ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ
৩. ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তি
৪. ১৯৭১ এর স্বাধীনতা পরবর্তী সংকট
৫. বৈষম্যমূলক বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রভৃতি।
লোকসঙ্গীতের মর্মবাণীকে উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই। একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই মিলনে গান জেগেছে। সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য্যরে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। পুরাণ-কোরানে ঝগড়া বাঁধেনি। লোক কবি যখন গেয়ে ওঠেন:
হামুক দামুক শামুক পাল
আমরা হলাম ছাওয়াল পাল
ক্ষ্যাতা আনতে মনে নাই
শীতে বড়ো কষ্ট পাই
ভিখ দ্যাও বাড়ি যাই।
সুবোল সুবোল।
লোকসঙ্গীত অর্থে, এককথায় লোকজীবনের গানকে বোঝায়। বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের প্রকৃতির মতোই অনন্য ও স্বতন্ত্র। লোকসঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন, যাহা একটি মাত্র ভাব অবলম্বন করিয়া গীত হইবার উদ্দেশ্যে রচিত ও লোকসমাজ কর্তৃক মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়, তাহাকেই লোকসঙ্গীত বলে। সুকুমার রায় তার ‘লোকসঙ্গীত জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থে বলেন, ‘সভ্য সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রামীণ সমাজের গান বিশেষ করে কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানবগোষ্ঠীর গান, যে গান মুখে মুখে গড়িয়ে এসে একটি বিশেষ শ্রেণির সঙ্গীতরূপে পরিগণিত, সে গানই লোকসঙ্গীত নামে অভিহিত।’ মযহারুল ইসলাম বলেন, ‘সুদীর্ঘকাল যাবৎ লোকের মুখে মুখে প্রচলিত এবং সমাজের নিজস্ব বলে স্বীকৃত গানগুলোকে লোকসঙ্গীত বলে।’ লোকসঙ্গীতের উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহের মধ্যে কোথাও কোথাও লোকসমাজ বলতে গ্রামীণ সমাজকে নির্দেশ করা হলেও বর্তমান বাস্তবতায় গ্রাম এবং শহর উভয়কেই নির্দেশ করা হলো।
মাঙার গান নামে স্বতন্ত্র গান রয়েছে বাংলাদেশের চলনবিল অঞ্চলে। ফোকলোর গবেষক সরদার এম এ হামিদের বর্ণনা মতে, প্রতি বছর পৌষ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রামের তরুণ ও যুবকেরা দল বেঁধে হিন্দু-মুসলমানের বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা মাগত। দু’তিন হাত লম্বা একটি কঞ্চি বা যষ্ঠির মাথায়ও গায়ে কাটা পাট সূতা দিয়ে বেঁধে সোনা রায়ের প্রতীক তৈরি করা হয়। অনেকেই লাল নীল নানা প্রকার রঙিন কাগজে মোড়ায় এবং পাটের ফুলগুলোকে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করে। প্রত্যেক দলের এক-একটি করে ‘ সোনা রায়’ (প্রতীক) থাকে। এই দলকে বলে সোনা রায়ের দল।’ সোনাপীর এবং সোনা রায় অভিন্ন ব্যক্তি। হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজে সমান সমাদৃত তিনি। সোনা রায়ের গান গেয়ে পুরো পৌষ মাসে যে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, রসুন, মসলা আদায় হতো তা দিয়ে পৌষসংক্রান্তির দিনে ছেলেরা শিরনি পোলাও করে গ্রামবাসীর মধ্যে বিতরণ করত। মাঙার গানের মধ্যে ছেলেরা সোনাপীর, মানিকপীর, কালু, গাজী, চম্পাবতী, মাদারপীর, নিমাই সন্ন্যাস, কেশব সাধু প্রমুখের প্রশংসাসূচক স্তুতি গেয়ে ভিক্ষা করতো। পৌষসংক্রান্তিতে ছেলেরা উল্লাস করে ১লা মাঘ নদীতে গোসলে নামতো এবং এবং গোসল শেষে শিরনি রান্না করতো। সোনা রায়ের গানের দলের সদস্যরা খেরু নামে পরিচিত। দলের প্রধানকে বলা হয়ে থাকে মূল খেরু। মূল খেরু গানের প্রধান অংশ গায়, সহকারীরা কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করে মূল গায়েনের সাথে সাথে গেয়ে পুরো গানটি শেষ করে। যথা:
আসলোরে লাল শালিকা
পায়ে দিয়া মোজা
ত্যালের হাড়িত ডুব দিয়া ফ্যাচকা হলো রাজা।
ফ্যাঁচকা উঠিয়া বলে-
হামতো বড়ো জানি
তিরভূবনের পাখিরে
টেনে তোলো পানি
যার যার পাখিরে
চালে করে বাসা
কর্মের কপালের দোষে
খাইট্যা মরে চাষা।
চাষাগারে কামাইরে ভাই
খায় বড়ো বড়ো লোক
খায় আর দায়রে
মোছ মুচ দাড়ি
উচিত কথা কইলে পড়ে
দেয় লাড়কির বাড়ী;
লাড়কির বাড়ি যেমন তেমন
কঞ্চির বাড়ি দঢ়ো
আল্লাহর আলেমের ভিখ
এই বাড়ি জড়ো।
সুবোল সুবোল।
৩.১ বাংলার সমাজ কাঠামো: ভিক্ষাবৃত্তি ও পুঁজিবাদের বিকাশ
পেশা, বৃত্তি তথা জীবিকার আবর্তে প্রতিটি মানুষই একটি সমাজের মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সামাজিক ভূমিকার সমন্বয়ে সমাজ কাঠামোর অংশ হয়ে ওঠে। প্রতিটি সমাজের কাঠামোই ঐতিহাসিক নানাবিধ শর্তযুক্ত উপাদানে বিন্যস্ত। একটু পেছনে গেলে দেখা যায় যে, প্রাক ব্রিটিশ যুগে বাংলা তথা ভারতবর্ষের আর্থ-রাজনৈতিক কর্মপন্থা পশ্চিম ইউরোপের সামন্তযুগের ব্যবস্থার মতো ছিলনা। ইউরোপীয় সামন্তবাদের মধ্যে ভূমিমালিক বনাম ভূমিদাসদের মধ্যে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগজনিত সম্পর্ক, ভূমির ওপর অধিকার, ব্যক্তিগত সামরিক বাহিনি গড়ে তোলা ইত্যাদি প্রধানতম শর্ত হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। বাংলা তথা ভারতবর্ষের সামন্ত যুগের ইতিহাসে কিন্তু এমন লক্ষ করা যায় না। ভারতবর্ষে নাগরিক সমাজ গড়ে না ওঠার পেছনে বর্ণভেদ প্রথা, অন্তর্বিবাহ প্রথা এবং নবগঠিত নগরকেন্দ্র ধ্বংসের মতো পদক্ষেপ গ্রহণের মতো নানাবিধ বিষয়ের সাথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে ইউরোপের মতো নাগরিক সমাজ সামন্ত যুগে বিকাশ লাভ করেনি। যদিও ব্রিটিশ বা মুসলিম শাসনের পূর্বেই একটি ধনিক শ্রেণি ভারতে ছিল, কিন্তু তাদের দ্বারা ইউরোপীয় সমাজের ন্যায় কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। মধ্যযুগীয় বাংলায় অতিরিক্ত মুনাফা লোভী তথা মহাজনী পুঁজিবাদের একটা উদ্ভব ছিল সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। মূলত, ধনী হিন্দু কৃষক ও বণিক সম্প্রদায়ের একচেটিয়া অধিকারে ছিল মহাজনী বৃত্তি। ইসলামী দর্শনে সুদগ্রহণে নিরুৎসাহিত করার কারণে প্রাক-ব্রিটিশ ও বৃটিশ শাসনামলে বাংলায় মুসলিম পুঁজিপতি বা মহাজনদের প্রাধান্য খুব বেশি দেখা যায় না। বঙ্গ-ভারতীয় বণিক শ্রেণি ইউরোপের সমাজের ন্যায় সামন্ত শাসক বিরোধী কোনো শক্তি গড়ে না তোলায় এখানে সমাজ কাঠামো ইউরোপের ন্যায় রূপলাভ করেনি। এ সকল পুঁজিপতিরা সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে খাজনা পরিশোধের বিনিময়ে জমিদারি বা তালুকের অধিকার লাভ করলেও মালিকানা লাভ করেনি। ফলে, ব্রিটিশের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় জমিদারি স্বত্বলাভের কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। তার পূর্বে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ জমাদান করাই ছিল জমিদারি রক্ষা করার পূর্ব শর্ত। লর্ড কর্নওয়ালিসের ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিস্বত্ব আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলার ক্ষুদ্র মুসলমান অভিজাত শ্রেণির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। পুঁজিপতি হিন্দু বণিক ও মহাজন গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে উদ্ভব হয় নতুন জমিদার গোষ্ঠীর। এই নতুন কাঠামোর বাংলার অধিকাংশ জমির মালিকানা উচ্চবর্ণের হিন্দু স্প্রদায়ের হস্তগত হয়। জমিদারদের অধীনে থাকে পত্তনিধারী জোতদার, গণতিদার, তালুকদার ও ভূঁইয়াদের মতো মধ্যবর্তী খাজনা আদায়কারী গোষ্ঠী। ঊনিশ শতকেও বিত্তবান হিন্দু শ্রেণিভুক্ত সর্বোচ্চ বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈশ্যগণের অর্ধেক ছিল প্রজাদের পরিশোধিত খাজনা দ্বারা পরিচালিত জমিদার শ্রেণি; এক চতুর্থাংশ ছিল আইনজীবী, চিকিৎসক ও পুরোহিত শ্রেণির মতো পেশাজীবীগণ, বাকিরা ছিল অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা জমিদারের কর্মচারী শ্রেণি। এই শ্রেণি থেকে শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় রাজনৈতিক সচেতন একটি শ্রেণি বেরিয়ে আসে যারা হিন্দু সমাজকে নেতৃত্ব প্রদান করে। মুসলমান সমাজে আধুনিক বিকাশমান ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে মধ্যবিত্ত এবং রাজনৈতিক সচেতন একটি শ্রেণি গড়ে উঠতে বিলম্ব হয়। বিশেষ করে ওয়াহাবী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ সচেতন মুসলিম শ্রেণি যতটা নিজ সমাজকে শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক জ্ঞানে প্রাগ্রসর করে গড়ে তোলা যায় সেদিকে মনোযোগী না হয়ে; ইসলামের বিশুদ্ধবাদী শরীয়ত চর্চাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সমাজ সংস্কারের জাগতিক অবস্থান থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে, কিছুসংখ্যক মুসলিম উচ্চশিক্ষা লাভ করলেও মুসলিম সমাজের সংখ্যার তুলনায় তা অতি অল্প। এভাবে, বিদ্যমান বৈষম্যের ফলে মুসলিম সমাজে দারিদ্র্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভিক্ষাবৃত্তি জীবিকার একটি অনিবার্য মাধ্যম হয়ে ওঠে। যদিও বিশেষ কোনো পরিসংখ্যান নেই, তবুও তৎকালীন সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা যায় ভিক্ষবৃত্তি প্রাক-বৃটিশ শাসন ব্যবস্থার পর্ব থেকে বৃটিশ শাসনামলে মুসলিম সমাজে অনেক বেড়ে যায়।
৩.২ নবাবী শাসনের অবসান: বেকার থেকে দস্যু ও ফকির-সন্ন্যাসী
ব্রিটিশ কোম্পানীর শাসনামলে বাংলার নবাবদের সেনাবাহিনি ও শাসন কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়। এর ফলে লক্ষ লক্ষ বেকার তৈরি হয়। এ সময় বাংলার সামাজিক জীবনে এক বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থির সৃষ্টি হয়। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে বিষয়টি আলোচনা সাপেক্ষ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর শাসনের মূলনীতি ছিলো অর্থ। এই অর্থের লোভে পড়ে বেনিয়া কোম্পানির শাসকগোষ্ঠী সুপরিকল্পিতভাবে এদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়ায়, পরিবর্তে কোনো সুচিন্তনীয় রক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এদেশের জনজীবনে নেমে আসে ভয়াবহ অভাব-অনটনÑঅন্নাভাব। মুঘল শাসনামলে যে ফকির সন্ন্যাসীগণ বিনা খাজনায় জমি ভোগদখল করে আসছিলো এবং সর্বত্র যাদের গতি ছিলো, তাদের ওপর খাজনা নির্ধারণ ও বহির্গমনের ওপর যখন হঠাৎ কঠোর বিধি-নিষেধ এবং অতিরিক্ত কর প্রয়োগ করা হলো তখন স্বভাবতই নিরীহ ফকির সন্ন্যাসীগণ বিদ্রোহী ভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। এমনকি ইংরেজ শাসকগণ এদের তীর্থ ভ্রমণকেও শোষণের একটি বিশেষ ক্ষেত্রে পরিণত করে। বলা হয়ে থাকে, এরা একদিকে কৃষক অপরদিকে ফকীর সন্ন্যাসী আর এই উভয় দিক থেকেই তারা বিদেশী শাসকদের শোষণ ও উৎপীড়নের শিকারে পরিণত হয়েছিলো বলেই নিজেদের জীবীকা ও ধর্ম রক্ষার জন্য তাদের বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিেেলা না। কাজেই দলবদ্ধ হয়ে জমিদার মহাজনদের গোলায় জমানো ধান-চাল এবং সম্পত্তি লুট করা ছাড়া বিদ্রোহীদের গত্যন্তর ছিলো না। এছাড়া ছিয়াত্তরের মনন্বন্তরের ফলে বাংলাদেশের কৃষক জনসাধারণের যে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছিলো তার তুলনা সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক হান্টার বলেন, “এ দুর্ভিক্ষে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, পরবর্তী দুই পুরুষকালেও তার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয় নি। ……. ১৭৭১ সাল শুরু হওয়ার আগেই এক পুরুষ কৃষকের এক তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। প্রত্যেকটি জেলাতে এই কাহিনী শুনতে পাওয়া যেত।”
দুর্ভিক্ষের কারণ খুঁজতে গিয়ে হান্টার বলেন, “প্রদেশে তখনও কিছু পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ ছিলো এবং তা দিয়ে আরো ন’ মাস চালানোর প্রয়োজন ছিলো। … কিন্তু ফসল কাটার সময় তা কিনে মজুদ করে রাখা হতো। পরে অনটনের সময় চড়া দামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করা হতো। ফলে দ্রুত দাম বেড়ে যেত। কাজেই দেশের কৃষক জনসাধারণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। হান্টার সাহেব আরো বলেন, “দুর্ভিক্ষ পরবর্তী কয়েক বছরে বহু সহায় সম্বলহীন নিরন্ন চাষী যোগ দেওয়ায় তাদের (ফকির-সন্ন্যাসীদের) সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এসব কৃষকদের না ছিলো বীজধান, না ছিলো চাষাবাদের সাজ-সরঞ্জাম। ফলে একরকম বাধ্য হয়েই তারা সন্ন্যাসীদের দলে যোগ দেয়। এছাড়া ফকির সন্ন্যাসীদের সাথে যোগদান করে মোগল বাহিনী থেকে চাকুরীচ্যুত সৈনিক, মসলিন তৈরির বেকার কারিগর, জেলে, তাতী, কামার এবং কুমার সম্প্রদায়। উপরোক্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বাংলার সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, তাতী, তেলী, কারিগর, জেলে, কুলী কামিনের মধ্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিলো। বাংলাদেশে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপকতা লাভ করে এই কালপর্ব থেকেই। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার বিপুল জনসংখ্যা খাদ্য-বস্ত্রহীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, এ অবস্থায় ভিক্ষবৃত্তি সমাজে সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তিজনিত কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করতে থাকে উভয় বাংলায়। ভিক্ষাবৃত্তি তখন ব্যাপকতা লাভ করে উভয় বাংলাতেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে পাক সেনাবাহিনি এদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, গণহত্যা করে। স্বাধীনতা অর্জন পরবর্তী সরকারের পক্ষে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তৎক্ষণাৎ দারিদ্র্য বিমোচন করার মতো সামর্থ্য ছিলনা। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলে বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তিও যথাযথ ছিল না। এ সকল কারণে সমাজে দারিদ্র্য ও ভিক্ষাবৃত্তি মহামারী রূপে দেখা দেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, শিল্পায়ন, অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য খুব বেশি পরিমাণে বেড়ে গেছে। মানুষের চিত্তবিনোদন, ভোগ্য চাহিদা পূরণের সামর্থ্য বৃদ্ধি পেলেও সামাজিক বৈষম্য ভয়াবহ রূপে বিদ্যমান থাকায় সমাজে দারিদ্র্য নতুনরূপে ছড়িয়ে পড়ছে। নগরায়ণের ফলে অসহায় ও বেকার মানুষেরা শহরমুখী হওয়ার কারণে ভিক্ষাবৃত্তির মতো বিষয়গুলি ছিন্নমূল মানুষের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি ব্যবসায়ীক পেশাদারিত্ব চক্রের সিন্ডিকেটেও রূপ নিয়েছে।
৪. ভিক্ষুকের গান: বর্তমান প্রেক্ষিত
সাধারণ ভিক্ষুকগণ প্রধানত ইসলামী সুরা-কেরায়েত বা গজল গেয়ে ভিক্ষা মাঙন করেন। হিন্দু ভিক্ষুকগণ বৈষ্ণব পদাবলী বা রাধাকৃষ্ণের গান গেয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন সহানুভূতি উদ্রেককারী বাক্য বা প্রার্থনাসূচক গান গেয়েও অনেকে ভিক্ষা প্রার্থনা করে থাকেন। এই শ্রেণির ভিক্ষুকদের সাথে হাট-বাজার, রেল-বাসস্টেশন, আদালত চত্বর, রাস্তার মোড় প্রভৃতি স্থানের ভিক্ষুকদের ভিক্ষা প্রার্থনার গানের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। এ সকল ভিক্ষার গানের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে লোকের সমাগম। গান গেয়ে যে যত বেশি লোক সমাগম ঘটাতে পারবে তার ভিক্ষা লাভ করার পরিমাণ তত বেশি। উদাহরণস্বরূপ আক্কেলপুর অঞ্চলের অন্ধ গায়ক আরিফের কথা বলা যেতে পারে। বয়স ৩৫ এর মতো। আরিফ লোকাল ট্রেনে চাঁপাই নবাবগঞ্জ সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী থেকে চিলাহাটি রুটে ভিক্ষা করে। সপ্তাহে কয়েকদিন আব্দুলপুর বা নাটোর রেলস্টেশনে নেমে আসর দেয়, চা খায়, মানুষের সাথে গল্প করে। আরিফ কিছু কিছু আধ্যাত্মিক গান গাইলেও বিচ্ছেদী, সিনেমার গান, বাউল, মারফতী গেয়েই মূলত ভিক্ষা করে থাকেন। দীর্ঘদিন যাবত হাটুরে কবিতা, ভিক্ষুকের গান, পুঁথি প্রভৃতি সংগ্রহের কাজ করে আসছেন সিরাজগঞ্জের সলংগা থানার মালতীনগর নিবাসী মোঃ আব্দুল গণি তালুকদার। তিনি ¯œাতকোত্তর পড়ালেখা করে বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের পদে চাকরিরত। তার পরিচিত একাধিক ভিক্ষুক রয়েছেন, যারা গান গেয়ে ভিক্ষা করে থাকেন। সিরাজগঞ্জের দিলীপ রায় পুরনো দিনের বাংলা গান, বিশেষত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দের মতো শিল্পীদের গান বেশি গেয়ে থাকেন। স্থানীয় বয়াতিদের গান গেয়েও কেউ কেউ অর্থসাহায্য চেয়ে থাকেন। আব্দুলপুর স্টেশন, নাটোর স্টেশন, শরৎনগর স্টেশন, উল্লাপাড়া স্টেশন, রাজশাহী স্টেশন প্রভৃতি স্থানে যে সকল গায়কদের পাওয়া যায়, তারা জনপ্রিয় ধারার বাংলা গান গেয়েই ভিক্ষা করে থাকেন। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার একদিলতলার হাটে যে সকল গায়কদের পাওয়া যায়, তারা মূলত মারেফতি এবং পরিচিত বাউল গানগুলোই পরিবেশন করে থাকেন। নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার মৌখাড়ার হাটে মাঝে মাঝে কিছু দলবদ্ধ ভিক্ষুক পাওয়া যায়। তারা মূলত মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে আধ্যাত্মিক ঘরানার গানগুলোই গেয়ে থাকেন। তবে, তাতের গানের বিষয়বস্তুর সাথে কখনো বা সমসাময়িক ঘটনার সংযোগ লক্ষ করা যায়। তারা অধিকাংশ সময় দলবদ্ধ হয়ে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে ‘ আমার আল্লা নবীজীর নাম’ গানটি গেয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য তাদের গানে লক্ষ করা যায়নি। নি¤েœ কিছুসংখ্যক গান উপস্থাপন করা হলো:
১. কেন রে বেনামাজীরা, নামাজ কেন পড়না?
নামাজ হইবে সঙ্গের সাথী চিন্তা-ভাবনা করনা!
বেনামাজী মারা গেলে দোযখ হয় তার ঠিকানা।
যখনই আসবে ফজর!
ফজর পড়বে যে জনা,ফজর হইবে মাথার ছাতি-
সূর্যের তাপ আর লাগবেনা।
কেন রে বেনামাজীরা, নামাজ কেন পড়না ?———ঐ
যাবে ফজর আসবে যোহর
যোহর পড়বে যেজনা,
যোহর হইবে পায়ের খড়ম, তামার তাপ আর লাগবে না।
কেন রে বেনামাজীরা, নামাজ কেন পড়না ?———ঐ
যাবে যোহর আসবে আছর,
আছর পড়বে যেজনা!
আছর হইবে হাতের রুমাল,মুছবে গায়ের ঘামখানা
কেন রে বেনামাজীরা, নামাজ কেন পড়না ?———ঐ
যাবে আছর আসবে মাগরিব,
মাগরিব পড়বে যেজনা!
মাগরিব হইবে পেটের খোড়াক, ক্ষুদার তাপ আর রইবে না
কেন রে বেনামাজীরা, নামাজ কেন পড়না ?———ঐ
যাবে মাগরিব আসবে এশা,
এশা পড়বে যেজনা!
এশা হইবে কবরের আলো,অন্ধকার আর রইবে না।
কেন রে বেনামাজীরা, নামাজ কেন পড়না ?———ঐ
২. সাফায়তের নৌকা নবী সাজাইয়া
পুলছুরাতের ঘাটে রাখবেন বান্ধিয়া।।
কাগজের টাকা,রুপার টাকা লইবেন না
বেনামাজীক নৌকায় তিনি তুলবেনা।
সাফায়তের——————-ঐ
হাসান হোসেন দ্বারের বৈঠা মারিবেন
হযরত আলী নৌকার মাস্তুল হইবেন,
সাফায়তের——————-ঐ
মা ফাতেমা নৌকার বাদাম হইবেন
দয়ার নবী নৌকার মাঝি সাজিবেন,
সাফায়তের——————-ঐ
৩. শোনেন শোনেন বেনামাজী বসিয়া
মৃত ব্যক্তি কিরুপে যায় চলিয়া।।
গোসলও করায়ে কাফন পরাইলো
মৃত ব্যক্তি কেন্দে কেন্দে কহিল!-
যে চারিজন নিয়া যাইবে আমারে
তারাই বুঝি সঙ্গে যাইবে কবরে।।
অবশেষে তারা চারজন গেলনা,
কবরেতে নামাইলো তিনজনা।।
অবশেষে তারাও তিনজন উঠিল
সাইরে সাইরে বাশের খাটনী পরাইলো।।
খাটনী শেষে কান্দে মোর্দা হায় রে হায়
আমার দুনিয়াতে আপন বলতে কেহই নাই।।
কোথায় রইলেন মা জননী বসিয়া
দুগ্ধের দাবী দেনগো মাওজান ছাড়িয়া,
শিশুকালে পেলেছেন আম্মা যতনে
চিরবিদাই দেনগো মাওজান কেমনে! ।।
কোথায় রইলেন আব্বাজানগো বসিয়া
আপনার সন্তানেরও কষ্ট জানগো আসিয়া।।
৪. শোন সবে নবীজিরও হাকিকত
কেছা(কেমন)ছিল বেল্লালেরও মহাব্বত।।
মধুর সুরে বেল্লাল আযান ফুকারে
কেন্দে কেন্দে নবীজিরও হুজারে।।
যখন বেল্লাল মোহাম্মাদ নাম মুখে লয়
তখনিতে কলিজা তার ফেটে যায়।।
রাসুলুল্লাহ মুখে বেল্লাল বলিয়া
মিনার হইতে গেলেন তিনি পরিয়া।।
শোন সবে——————–ঐ
হাসান হোসেন দুনো ভাইও বলিল
মদীনা আজ অন্ধকারও হইলো।।
পাইবা পাইবা,পাইবা বেল্লাল আমারে-
পাইবা বেল্লাল,আমায় পাইবা তিনখানে
রোজহাশরে,কিয়ামত আর মিজানে।।
শোন সবে——————–ঐ
৫. আহা, ইসলামের আলো জ্বালায়ে দিয়া রাসুল
ঘুমাইয়া আছেন সোনার মদীনায়।।
আমি পাহাড় ঘুরিলাম,জঙ্গল খুজিলাম রাসুল
তোমার দেখা তবু পাইলাম না।।
কিংবা যখন গাওয়া হয়:
৬. নন্দ গেল বাথানে, দশ গেল ঘাটে
খালি ভা-ার পায়্যা কিষ্ট সবই ননী লোটে।
কোরাস: ও মা দয়া নাই রে তোর
মা হয়ে বেটাক বলো, তুমি ননী চোর।।
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনি নি¤েœাক্ত গানটিতে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে:
৭. জ্যৈষ্ঠ আর আষাঢ় মাসে ঝাঁকে চলে মাছ
ওাধা গেল জল আনিতে কানাই নিল পাছ।
( কোরাস: তবে চল সখী সরোবরে জল আনিতে যাই।।
Ñরাধের কাপড় কানাইর বাঁশি রাখলো এক ঠাঁই,
ওাধের কাপড় রাধে নিল কানাইর বাঁশি নাই।
বাঁশিটি হারায়ে কানাই যায়রে গোয়ালপাড়া,
ঘরে ঘরে জিজ্ঞেস করেÑ বাঁশি নিছিস তোরা?
বাঁশিটি হারায়ে কানাই যায়রে মালী পাড়া,
ঘরে ঘরে জিজ্ঞেস করেÑ বাঁশি নিছিস তোরা?
Ñআমরা তো লেই নাই বাঁশি লিতে দেখেছি,
আঁচলে ঢাকিয়া বাঁশি লিছে তোর মামী।
হুকা দে মা কলকে দে মা লড়ি দে মোর হাতে
গো-ধেনু চরাইতে যাব দাদা বলাইর সাথে।
( কোরাস: মাধব সুখে রাখিও ধেনু কি জাগহে
এ বাছা রহিল কোন বনে।।
ঘাম্বা বলে রাখাল সবে খেদাইল পাল
পিছে পিছে যায়রে হাঁটি কালু আর গোপাল।
৫. শেষ কথা
মাঙনের গান যখন পৌষ মাসে রাত জেগে গাওয়া হয়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে জাগগান বা জাকগান। কিন্তু, ভিক্ষুকের গান বলতে কেবল ভিক্ষা মাঙনের গানকে বর্তমান প্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ভিক্ষা মাঙনের জন্য ভিক্ষুকেরা যে সকল গানের কথা ব্যবহার করেন সেখানে জাগগান, বাউল গান, পালাগান, মারেফতি, বিচ্ছেদী প্রভৃতি গানেরও ছাপ পাওয়া যায়। শ্রোতাদের রুচি এবং পছন্দ অনুযায়ী আসর জমাতে ভিক্ষুকেরা সমসাময়িক জনপ্রিয় গানগুলোই বেশি গেয়ে থাকেন। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে বাউল গানের অনুরোধ এলে তারা তখন বাউল গান গেয়ে মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে থাকেন। ভিক্ষুকের গানে বিশেষ কোনো বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যায়নি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, কলসি প্রভৃতি বাজিয়েই তারা চমৎকার সুর তোলেন। এক কথায় বলা যায়, আড়ম্বরহীন আয়োজনে সর্বপ্রকার গানের সুর নিয়ে ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষুকগণ যে সকল গান করে থাকেন, তা একদিকে যেমন তাদের জীবিকার মাধ্যম; অপরদিকে সর্বোস্তরের মানুষের মনোরঞ্জনেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। কাজেই, বাঙালির জীবনে ভিক্ষুকের গানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
There is no related posts.