মিয়ানমার বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা চক্তি ও শুভংকরের ফাকি
ড. আমিরুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ব-সধরষ: ঢ়শশধহধশ@ৎঁ.ধপ.নফ
পবষষ: ০১৭১২৯৬৫৫২৫

এক বৃহস্পতিবারে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া এবং প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়াসহ জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস হলো। পরবর্তী বৃহস্পতিবারে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। এই সমর্থন এবং সমঝোতা স্বাক্ষর কতটুকু কাজে দেবে, তা ভাবনার বিষয়। কারণ, যে রোহিংগা নিয়ে জাতিসংঘে এই ভোটাভুটি; পর্যবেক্ষক হিসেবে জাতিসংঘে তাদের প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন ছিল। জাতিসংঘের মাধ্যমে রোহিংগা প্রতিনিধির সাথে মিয়ানমার সরকারের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করার মতো পরিস্থিতি তৈরি একান্ত জরুরি। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিংগারা এদেশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও জীবিকার ওপর সীমাহীন সমস্যা ও সংকট তৈরি করছে। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি এবং পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারের সাথে রোহিংগাদের সমঝোতা চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। ১৬ নভেম্বর ২০১৭’র প্রস্তাবে জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়া ১৭১টি দেশের মধ্যে পক্ষে ভোট দেয় ১৩৫টি দেশ, বিপক্ষে ভোট দেয় ১০টি দেশ এবং ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকে ২৬টি দেশ। এই প্রস্তাবে সমর্থন দেওয়া ও না দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের জনগণের মনে প্রতিবেশি এবং বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে। মনে রাখতে হবে, এই প্রস্তাবটির মাধ্যমেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছে না তো? মিয়ানমার কিন্তু বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষের আসনে বসিয়ে রোহিংগা নিধন এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুটিকে চাপা দেবার চেষ্টা প্রথম থেকেই করে আসছিল। প্রস্তাবটি যখন জাতিসংঘে উত্থাপন করা হয় তখনও বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের একতরফা এবং একটানা গুলির শব্দ শোনা গেছে। দেখা গেছে আগুনের লেলিহান শিখা। দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আশা করছে মিয়ানমার রোহিংগাদের ফিরিয়ে নিতে দুই মাসের মধ্যে প্রক্রিয়া শুরু করবে। প্রশ্ন হলো মিয়ানমার কি আদৌ এই চুক্তি মেনে চলবে, কিম্বা রোহিংগাদের ফিরিয়ে নিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? মিয়ানমারের পূর্ববর্তী আচরণ এবং ইতিহাস কিন্তু সে সাক্ষ্য বহন করে না। দ্বিতীয়ত, রোহিংগা ইস্যুটি কি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক কোনো সমস্যা? বাংলাদেশ রোহিংগাদের মানবিক আশ্রয়দাতা। তবে বাংলাদেশ কেন দি¦তীয় পক্ষ হতে যাবে? বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পক্ষে রূপান্তর করতে মিয়ানমার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল এবং তারা শেষ পর্যন্ত সফলও হলো। কেবল দ্বিতীয় পক্ষই নয়, বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে মিয়ানমার সৈন্য সমাবেশ করলো, আকাশসীমা অতিক্রম করলো, সীমান্তে গুলি চালালো, সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া বসালো, স্থলমাইন পুঁতে রাখলো। শুরু থেকেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মিয়ানমার রোহিংগা গণহত্যা এবং নির্মূল প্রক্রিয়াকে আড়াল করতে বাংলাদেশের সাথে একতরফা একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা করতে থাকে। বাংলাদেশ সহিষ্ণুতা এবং বিচক্ষণতার সাহায্যে মিয়ানমারের যুদ্ধংদেহী এবং আক্রমনাত্মক আচরণকে মোকাবেলা করে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহানুভূতি এবং সমর্থন অর্জন করলো, যার ফল জাতিসংঘে বিপুল ভোটে সমর্থন লাভ।
রোহিংগা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক এবং সমাধানও প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে। প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ পরস্পরের শত্রু কিম্বা প্রতিপক্ষ নয়, প্রতিবেশিও বটে। পর্যটন এবং ঔষধ খাতে মিয়ানমারে বাংলাদেশের বিপুল ব্যবসায়িক বিনিয়োগ রয়েছে। রোহিংগা সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং মিয়ানমার তার নিজ দেশে বসবাসরত রোহিংগা নাগরিকদেরকে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, উচ্ছেদের মাধ্যমে নাগরিক মর্যাদা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, অস্বীকার করছে। মিয়ানমারের এই নির্মূল ও নিধন অভিযান কেবল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকেই নয়। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯২, ২০১২ সাল পর্যন্ত যে সকল সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার কোনোটিই মিয়ানমার অনুসরণ করেনি। বর্তমান চুক্তিটিও সেই ধারাবাহিকতা। জাতিসংঘের প্রস্তাবটি বিপুল ভোটে পাস হওয়ার পরে মিয়ানমার খুব তাড়াহুড়ো করেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। স্পষ্টতই এটা তাদের নতুন কৌশল। আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্য মিয়ানমার চুক্তিটি করতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানালো এবং চুক্তি স্বাক্ষরিতও হলো। এই চুক্তির মাধ্যমে আপাত ফল লাভের আশায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের সমর্থনকে কাজে লাগাতে একরকম ব্যর্থ হলো। অপরদিকে, রোহিংগা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ বছর যে সমর্থন পেয়েছে অতীতে তা কখনো ঘটেনি। এটা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র এবং কূটনৈতিক সফলতাও বটে। রোহিংগারা বিশ্বের সবচাইতে নিপীড়িত জাতি। শত শত বছর ধরে তারা আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করতে মিয়ানমার সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও জাতিসংঘ ফোরামে প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিকভাবে রোহিংগা প্রতিনিধিত্বের। জাতিসংঘের অধিবেশনে রোহিংগাদের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলে এবং জাতিসংঘের উদ্যোগেই রোহিংগা প্রতিনিধির সাথে মিয়ানমার সরকারের চুক্তি করা হলে রোহিংগা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হতেই পারে। যে কোনো দুটি দেশের মধ্যেই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ রোহিংগাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। ২০১৭ সালের ছয় লক্ষাধিক এবং পূর্ববর্তী সংখ্যাসহ প্রায় বারো লক্ষ রোহিংগা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সমগ্র মিয়ানমারে রোহিংগাদের সংখ্যা বত্রিশ লক্ষের অধিক। এই বিপুল জনসংখ্যার মধ্যে থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে আন্তর্জাতিক বিশ্বকেই এবং রোহিংগাদের সাথে চুক্তিতে বাধ্য করাতে হবে মিয়ানমারকে, তবেই রোহিংগা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশ পূববর্তী ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, তার সফলতা পেতে হলে জাতিসংঘের মাধ্যমে রোহিংগাদের সাথে মিয়ানমার সরকারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে হবে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। নয়তো আন্তর্জাতিক চাপ যখন স্তিমিত হয়ে আসবে, মিয়ানমার পুনরায় রোহিংগা নিধন শুরু করবে।