৭৫’র জুলাই মাস। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডে সাজসাজ রব। খুকী ওরফে সুলতানা ও শেখ কামালের বিয়ের গায়েহলুদ। আসন্ন বিয়ের আয়োজন নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ব্যস্ততা। বত্রিশ নম্বরে নয়, নতুন গণভবনে সম্পূর্ণ বাঙালি ঐতিহ্য ঘিরে গ্রামীণ আবহে এ গায়েহলুদের আয়োজন। ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ের গায়েহলুদ উৎসবে সমাগত অতিথিদের সমারোহ। গায়েহলুদের উৎসবের রং ক্রিসেন্ট লেকের লাল ইটের ঝকঝকে রঙের আবির যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েদেরই প্রাধান্য এখানে। বাঙালি ঘরানার সব আয়োজনকে ঘিরে যে উৎসবের রং লেগেছে তার স্পষ্ট ছাপ প্রতিটি অতিথির চোখে-মুখে। মেয়েরা রং খেলছে। একে অপরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে রঙের ছোপ ছোপ আবিরে। রং খেলা চললো অনেকক্ষণ। মনের রঙের সাথে সাথে রঙিন হয়ে উঠেছে প্রতিটি মুখ, শরীর ও পোশাক। রংখেলা শেষে রঙে রাঙানো মেয়েরা নেমে পড়লো লেকের পানিতে। লেকের পানি লাল রঙে রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অন্যান্য অতিথি এবং মেয়েদের সাথে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও নেমে পড়লেন লেকের পানিতে। মেয়েদেরকে পিছু ফেলে তিনি সাঁতরে ঘুরে এলেন লেকের এপার থেকে ওপার।
বিয়ের দিন বরযাত্রী দল ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর থেকে যাত্রা করলো বেইলি রোডের দিকে, উদ্দেশ্য অফিসার্স ক্লাব। বঙ্গবন্ধু পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান এবং জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল এবং ক্রীড়া নক্ষত্র সুলতানার বিয়ের উৎসবে অতিথিদের ভারে গমগম করছে বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাব। বাড়ির বড়ো মেয়ে হাসু সবার সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করছেন এবং সবকিছু ঠিকঠাক আছে কী না পরখ করে দেখছেন। অতিথিদের তৃপ্ত মুখের সাথে নিজের খুশি যোগ করে একে একে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করছেন। শেখ রেহানা বন্ধুদের নিয়ে মজার মজার গান গেয়ে সবার মনে আনন্দধারা বইয়ে দিলেন। বাড়ির একমাত্র এবং বড়ো জামাই এম ওয়াজেদ মিয়া অতিথিদের সাথে স্বভাসুলভ স্মিত-রাশভারি কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। বিয়ের সকল আয়োজন সম্পন্œ হলো। কয়েকদিন বাদে বাড়ির তৃতীয় সন্তান এবং দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের বিয়ে ঠিক হলো বঙ্গবন্ধুর বোনের মেয়ে রোজীর সঙ্গে। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। দুই ছেলে ও দুই বউসহ বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতার ছবি পরের দিন পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হলো। সাংবাদিকদের আগ্রহের শেষ নেই। বঙ্গবন্ধু পরিবারের যুগল বিয়ের সংবাদ পৌঁছে গেলো দেশের সমস্ত মানুষের কাছে। এই বিয়ের সংবাদে তাদেরও অপরিসীম কৌতূহল। নতুন বউদের বেনারসির ভাঁজ, কাঁচাহলুদের গন্ধ ও হাতে মেহেদির লাল রং তখনো মুছে যায়নি। জুলাই মাসের শেষে খবর এলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। তাঁরা যেকোনো সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারের ওপর হামলা করতে পারে। এই খবর বিচলিত করলো বঙ্গবন্ধুর জীবন-মরণের সাথী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে। সাতমসজিদ রোডের বাসা থেকে তিনি রাত ১১টায় গেঞ্জি গাঁয়ে পায়ে হেঁটে এলেন ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু তখন শোবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি এই খবরকে কোনো পাত্তাই দিলেন না। হেসে উড়িয়ে দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত নেই যে কোনো জাতির প্রতিষ্ঠাতা, জনক ও রাষ্ট্রপ্রধান এমন একটি সাধারণ বাড়িতে নিশ্চিন্তে সপরিবারে অবস্থান করতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তও নেই যে রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর দেশের মানুষকে এত ভালো বাসতে পারেন এবং বিশ্বাস করতে পারেন। তার বিশ্বাসের ভিত এতই মজবুত ছিল যে, সেদিন তাজউদ্দীন আহমদকে সজল নয়নে মন খারাপ করে চলে যেতে হয়েছিল। তাঁর বিশ্বাসের মাঝে কোনো খাত থাকার প্রয়োজন হতোনা, যদি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র এবং একাত্তরের পরাজিত শক্তি তাকে আততায়ীর মতো অনুসরণ না করতো। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিয়ে গণভবনে না উঠে তিনি রয়ে গেলেন ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের সাধারণ দ্বিতল বাড়িতে। বিশ্বাসের মূল্য দিয়ে সপরিবারে তিনি রক্তে রাঙালেন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের লাগোয়া স্বচ্ছ সরোবর।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গসহ জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ড বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপথগামী কয়েকজন উচ্চাভিলাষী জুনিয়র কর্মকর্তার কলঙ্কিত চেষ্টা মাত্র নয়। এর সাথে দেশি-বিদেশি এবং আন্তর্জাতিক চক্র সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। মনে রাখতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র, অর্থ এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; আন্তর্জাতিকভাবে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে নবজাতক বাংলাদেশের বৈদেশিক স্বীকৃতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নারীনির্যাতন, সম্ভ্রমহানির মতো মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডকে আড়াল করতে মিডিয়া ক্যু বা অপপ্রচারও চালিয়েছে। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল রাজনীতিক এবং নাগরিক নিক্সন প্রশাসনের পক্ষে ছিলেন না। তারা বাংলাদেশের স্বপক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন এবং নিক্সন প্রশাসনের সমালোচনাও করেছেন। সিআইএ এবং মার্কিন প্রশাসনের প্রকাশিত দলিলপত্র থেকে অনেক অজানা তথ্যই পরবর্তীতে জানা যায়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানের স্বৈরাচার সামরিক সরকারের বর্বর কর্মকান্ডের অন্ধ সমর্থক ও সহায়তাকারী। কিন্তু মার্কিন ডেমোক্র্যাট মেজরিটি কংগ্রেস ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল। কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘের (Gallagher) কংগ্রেসে প্রদত্ত তার বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টে (৩ আগস্ট, ’৭১) বলেন, ‘সন্ত্রাস সকল সময় মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। তা কখনোই তাদের বিশ্বস্ততা ও সহানুভূতিকে জয় করে না। তা শুধু স্বৈরাচার যার অধীনস্ত তাদের করা হয়েছে, তা বন্ধ করার জন্য এবং তাঁদের জীবন, তাঁদের সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য সংকল্পকে জোরদারই করে থাকে। সন্ত্রাস যতখানি পাশবিক হবে প্রতিরোধও ততখানি দৃঢ় হবে। পূর্ব পাকিস্তানে আজ সে ধরনেরই যুদ্ধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সামনে একটা নতুন ভিয়েতনাম ঘটতে যাচ্ছে; … পাকিস্তান তার বর্তমান আকারে টিকতে পারবে না। তার কারণ আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। একটি বেপরোয়া সরকারের বর্বর কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করে আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের মানবতাবাদী, মুক্ত এবং মুক্তিপ্রিয় ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করছি।’
তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের জন্মকে মেনে নিতে পারেনি বলেই সপরিবারে এর প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নির্মাতা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা তাদের বিশেষ মিশনে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তারা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে বিবিধ চক্রান্তের জাল বুনতে থাকে। এ প্রসঙ্গে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য রাজনৈতিক সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা শারমিন আহমদের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, ‘শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসাজশে ১৫ আগস্টে সংগঠিত সামরিক অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ছিল সেই বেসামরিক চক্র যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, একাত্তরে আব্বু যাদের ষড়যন্ত্রকে বলিষ্ঠভাবে প্রতিহত করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কারনেগি এন্ডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস বেসরকারি সংগঠনটি ১৫০ জনের বেশি স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা ও সিআইএ এজেন্টদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমে গণহত্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার ব্যাপারটি নয় মাসের একটি দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টা নেয়। রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশিত না হলেও সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলৎজকে রিপোর্টটি পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। রিপোর্টটি থেকে ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারের প্ররোচনায় এবং খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করার ব্যাপার এবং মোশতাকের ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার ব্যাপারটি উল্লেখিত হয়।’ লিফসুলৎজের তথ্যানুসন্ধান থেকে আরও জানা যায় ১৯৭৫-এ ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াকিবহাল ছিলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হতে চলেছে। অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকেই দেশীয় চক্রান্তকারীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে এবং সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত আশু সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপেক্ষা করে। অর্থাৎ, ‘এক দিকে যেমন মার্কিন দূতাবাস জ্ঞাত ছিল যে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে চলেছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গও এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের অন্যতম পরিকল্পক লে. কর্নেল আবদুর রশীদ ও লে. কর্নেল ফারুক রহমান, বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তদানীন্তন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জুনিয়র সেনা অফিসারদের অভ্যুত্থানের বিষয়টি অবহিত করে এবং উভয়ের সমর্থন লাভ করে। বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর যোগসাজসে এভাবেই সংঘটিত হয় এই নৃশংস হত্যাকাÐ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বর্তমানে বা অতীতেও কোনো ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এর পদ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং পার্সোনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদ যিনি ৭১ এর পঁচিশে মার্চ এর মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে গ্রেফতার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ৬৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু যখন যেখানে সভা-সমাবেশ করতে যেতেন, তখন ঢাকা- গ ওয়ান, সেমি ডিলাক্স একটা সাদা রঙের টয়োটা গাড়ি ব্যবহার করতেন, যার মালিক ছিলেন হাজী গোলাম মোরশেদ। এমনকি গোপন কোনো আলোচনা থাকলেও যিনি সঙ্গে থাকতেন, সেই ব্যক্তিটি ছিলেন হাজী গোলাম মোরশেদ। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন প্রমুখের কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে তুই সম্বোধন করতেন এবং জিয়াউর রহমান ডাকতেন নানা বলে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান এই হাজী গোলাম মোরশেদের পায়ে ধরে বঙ্গবন্ধুকে রাজি করিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফের পদ সৃষ্টি করান এবং প্রথম ও শেষ ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদবী লাভ করেন। বঙ্গতাজ কন্যা শারমিন আহমদ প্রথমে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মুখে হাজী গোলাম মোরশেদের নাম শোনেন এবং তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। শারমিন আহমদের ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার রয়েছে। যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার মোটিফ বদলে দেবার মতো তথ্যের যোগান দিতে পারে। শারমিন আহমদ নিদারুণ কষ্টের সাথে আরও লেখেন যে, ‘অতি বেদনাদায়ক ব্যাপারটি ছিল যে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা বিরোধী ও পাকিস্তান-মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী মোশতাক, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী- এই পরাজিত চক্রটিই স্বাধীনতার পর মুজিব কাকুর আস্থাভাজনে পরিণত হয়ে নিজ দলের ভেতর থেকেই ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলায় সহায়তাকারী জামায়াতে ইসলামী, আলবদর প্রভৃতি মৌলবাদী দলগুলো নিষিদ্ধঘোষিত হলেও নিজ দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ও মুজিব কাকুর প্রশ্রয়প্রাপ্ত ষড়যন্ত্রকারীরা রেহাই পেয়ে যায়। এরাই ছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। এরা মুজিব কাকুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হবে না, বরং এরা আঘত হানবে স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী, আপসহীন নেতৃত্বের ওপর, সে বিষয়ে আব্বুর কোনো সন্দেহ ছিল না। আব্বুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর খবরের কাগজে প্রকাশিত হলো আব্বুসহ ২৬ জন নেতাকে দুর্নীতির অভিযোগে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, জাতীয় চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মূল রাজনৈতিক সহযোগী। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুজিবনগর সরকারের এই চার নেতা নির্মাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ মুজিবনগর সরকারে এই চার নেতার পাশাপাশি থাকলেও মার্কিন এবং পাকিস্তান প্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং সন্দেহজনক। বৈদেশিক নীতিতে তিনি বিতর্কিত ভূমিকা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করেন, যা ছিল মুজিবনগর সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। তিনি চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে বিলম্বিত করে স্বাধীনতার পথকে বাধাগ্রস্ত করতে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সামনে তিনি বাধা হয়েছিলেন বলে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পরে এই চাটুকার-খুনী মোস্তাক বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করেন এবং তাজউদ্দীন আহমদসহ বঙ্গন্ধুর কাছের এবং প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষীদের দূরে রাখতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে মোস্তাক দেশপ্রেমিক এবং বঙ্গবন্ধুর কাছের নেতাদের শুধু জেলেই পোড়েননি, তাদের বাড়িতে নজরদারি এবং আর্মি দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করেন; যাতে তারা বাইরে যেতে বা কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারেন। এমনকি তাদের বাসার টেলিফোন লাইনও কেটে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান নির্মাতা তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের উপর নজরদারি ও হয়রানিমূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন মোশতাক আহমেদের সরকার। শারমিন আহমদের ভাষায়, “আব্বুকে গ্রেপ্তার করার পরও আমাদের গৃহবন্দি দশার অবসান ঘটলো না। তার ওপর শুরু হলো নতুন হয়রানি। আর্মি ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) লোকেরা আব্বুর বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে আম্মাকে নানরকম জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। আব্বুকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করে তারা নিজেরাই যেন হয়রান হয়ে গেল। দুর্নীতি তো দূরের কথা, তদন্তে আব্বুর বিরুদ্ধে তারা একটি সাধারণ নিয়ম লঙ্ঘনেরও প্রমাণ বের করতে পারল না। এসবির এক অফিসার শেষ পর্যন্ত শুকনো মুখে নিরাশ গলায় আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার বড় ছেলে কোথায়?’ আম্মা সোহেল ও আমাকে ডেকে আনলে, বললেন, ‘এই আমাদের একমাত্র ছেলে, সবার ছোট। আর এই আমাদের বড় মেয়ে।’ স্বাধীনতার শত্রæরা আব্বুর বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা করেছিল তাঁর বড় ছেলে হাইজ্যাকের সঙ্গে জড়িত। মোশতাক কারচুপি করে ১৯৭৩-এর নির্বাচনে জিতেছিলেন এবং মন্ত্রীর পদে থেকে নানাপ্রকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন যা সর্বজনবিদিত। দুর্ভাগ্য যে, সেই মোশতাক আব্বু ও অন্যান্য নেতাকে দুর্নীতির ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে জেলে নেয়। আব্বুকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়ানোর জন্য মোশতাক সমর্থিত আর্মি প্রশাসন এতখানি মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে আমাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়াও আমরা যে দর্জির দোকানে জামাকাপড় তৈরি করাতাম সেই দর্জিকেও ধরে নিয়ে নানারকম জেরা করেছিল। তারা যতই চেষ্টা করছিল আব্বুকে অভিযুক্ত করতে ততই তাঁর নিষ্কলুষ জীবন দীপ্তিময় হয়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে নানার বলা একটি ফার্সি প্রবাদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে–‘আনরা কে হেসাব পাক আস্ত, আয মোহাসেবে চেহ বাক আস্ত’ (যার হিসাব পরিষ্কার, সে হিসাব রক্ষকের ধার ধারে না)।” তাজউদ্দীন সাহেব পার্লামেন্টে সকল সদস্যের বক্তব্যের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি সবার আলোচনার নোট নিতেন। পার্লামেন্টে ছোট্ট বিরোধী দলের সদস্যদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন খুব গুছিয়ে, যুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে। এর বিপরীত চিত্রও উল্লেখ করা যায়। একবার স্পিকার মোহম্মদ উল্লাহর (পরবর্তীকালে স্বল্পকালীন রাষ্ট্রপতি) তিনবার অনুরোধের পর মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক বিরোধী দলের এক সদস্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হন। তিনি অর্ধেক দাঁড়িয়ে, অনিচ্ছুকভাবে বলেন যে তার আরও সময়ের দরকার।
‘বঙ্গবন্ধুর নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে সময় আমি চট্টগ্রামে ছিলাম এবং অনেক ঘটনা কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ আমার হয়। বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী। তিনি ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় হৃদয়গ্রাহী কথিকা পাঠ করে অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দেশপ্রেমিক। তিনি, আবুল কাশেম স›দ্বীপ এবং আরও ক’জন ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ২৬ মার্চ, ১৯৭১ এক কিলোওয়াটের রেডিও স্টেশন স্থাপন করেন। সেখানে থেকেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আব্দুল হান্নান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৫ মার্চ গত ২৬ শে মার্চের শুরুতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার হতে আব্দুল হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বেলাল মোহাম্মদ চট্টগ্রামের পটিয়া অঞ্চল হতে মেজর জিয়াকে কালুর ঘাটে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য একজন সিনিয়র মিলিটারি অফিসারকে দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা। বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, একারণেই যে ঐ দিনেই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। এই দেশপ্রেমিকেরা নিজেরাই বঙ্গবন্ধুর নাম দিয়ে ওয়্যারলেসে বিভিন্ন স্থানে মেসেজ পাঠান। ফোনেও তারা নিজেদের গ্রুপের মধ্যে একই বার্তা বিনিময় করেন।’
‘আর একটা ব্যাপার হলো বেলাল মোহাম্মদরা জানতে পারেন যে কয়েকজন বাঙালি আর্মি অফিসার কালুরঘাট থেকে কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন। তারা ২৭ মার্চ সেখানে গিয়ে ওই অফিসারদের বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বাংলায় লেখা একটি বিবৃতি দিয়ে সেটি পাঠ করতে বলেন। জিয়া বিবৃতিটি পড়ে নিজে কাগজ কলম নিয়ে ইংরেজিতে একটি বিবৃতি তৈরি করেন এবং সেটি পাঠ করে শোনান। সেই ইংরেজি বিবৃতিতে তিনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, যা আমি চাঁটগা থাকাকালীন নিজ কানে শুনি। আধঘণ্টা পর তিনি আরেকটি সংশোধিত ঘোষণা পাঠ করে শোনান। তাতে তিনি নিজেকে আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেননি, শুধু বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত কয়েকজনের বরাতে শুনেছি যে জিয়া নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করায় উপস্থিতদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তাদের প্রতিবাদের মুখে জিয়া নিজের ওই রাষ্ট্রপতিত্বের দাবি বাদ দিয়ে সংশোধিত ঘোষণা পাঠ করতে বাধ্য হন। আমার মতে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণকেই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে ধরা যেতে পারে।’
শারমিন আহমদের গ্রন্থে সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহর ডায়েরি থেকে ইংরেজি ভার্সনের বাংলা দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে পাকিস্তান এবং মার্কিন প্রশাসনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বর্তমান প্রজন্মের কাছে সুস্পষ্টকরণের সাথে ডায়েরির বাংলা তর্জমা অংশটি হুবহু তুলে ধরা হলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের প্রধান ব্যক্তিবর্গের কার্যকলাপ
১) ১৯৭৪ বা ’৭৫ সালে খন্দকার মোশতাক তার তেহরান সফরের সময় চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক অনির্ধারিত মিটিং করেন।
২) মোশতাকের ডান হাত বলে পরিচিত তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দীন ঠাকুর দুই সপ্তাহ ধরে ভারত সফর করেন। তাকে ভারতের তথ্যমন্ত্রী (পূর্ণ মন্ত্রী) অভ্যর্থনা জানান যা প্রোটোকলের বাইরে।
৩) যখন লাহোর কনফারেন্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধুকে সেখানে যোগদানে রাজি করাতে আসেন তখন প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দীন ঠাকুর তাদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
৪) মোহাম্মদ উল্লাহ ভাই আরও জানান “পূর্ব এশিয়ার নিউজ উইকের ব্যুরো চিফ আর্নল্ড জেটলিন, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কয়েক দিন পর কোলকাতা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এ সময় একদিন তিনি আমাদের এনার কার্যালয়ে এসেছিলেন। আমাদের এক্সিকিউটিভ এডিটর হাসান সাঈদের টেবিলের ওপর বসে সামনের একটি চেয়ারে পা রেখে (অনেক পশ্চিমা তৃতীয় বিশ্বের লোকদের সঙ্গে আচরণে এখনো যে ধৃষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে থাকে তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।- সাক্ষাৎকারদাতার উক্তি) আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হাসান সাঈদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তোমরা কি আগে থেকে এসব ব্যাপারে কোনো কিছু জানতে না বা আঁচ করতে পারোনি?’ উত্তরে তিনি জানান যে ম্যানিলায় তিনি বেনজির ভুট্টোর চাচা মমতাজ আলী ভুট্টোর সঙ্গে ডিনার করেছিলেন। সে সময় তাঁর কাছে একটি ফোন আসে এবং তাঁকে জানানো হয় যে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। তিনি এই তথ্যটি মমতাজ ভুট্টোকে জানান। তখন ভুট্টো স্মিত হাসি হাসেন [Knowing smile] কিন্তু কিছুই বলেননি। তাতে ধরণা করা যেতে পারে- এ বিষয়ে তারা আগে থেকে কিছু জানত।
৫) জেটলিন আরেক ঘটনা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, মাস দেড়েক আগে আমি ঢাকা এসেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে আমি সোজা তোমাদের সচিবালয়ে খন্দকার মোশতাকের অফিসে যাই। কিছুক্ষণ সেখানে কথা বলার পর তিনি আমাকে তার গাড়িতে করে তার সরকারি বাসভবনে নিয়ে যান। সেখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলি এবং খাওয়া-দাওয়া করি। এরপর ওইদনিই সন্ধ্যায় আমি ঢাকা থেকে কোলকাতা চলে যাই।
বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহই স্মরণ করিয়ে দেয় ৭৫ পরবর্তী শাসকদের হাতে পরে সংবিধান এবং দেশের জনগণের কী হাল হয়েছে। সবাই বঙ্গবন্ধু নন। কাজেই বঙ্গন্ধুকে যে অধিকার এদেশের জনগণ দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ যদি তাদের উপরই প্রয়োগ করেন, তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই শুধু নয় অভিশাপও বটে।
১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অভ্যুত্থানকারীদের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে খন্দকার মোস্তাক আহমদ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেন এবং দেশে সামরিক আইন জারি করলেন। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় তিনি ১৬ সদস্য বিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করলেন জনাব মোহাম্মদ উল্লাহকে। প্রধানমন্ত্রী করা হলো আবু সাঈদ চৌধুরীকে, সামরিক আইন জারি করা হলেও সংবিধান এবং সংসদ বাতিল করা হয়নি। উপরন্তু, আওয়ামীলীগ নেতাদের চাপ প্রয়োগ এবং হয়রানি করে মন্ত্রীসভায় যোগদান এবং নিজ অনুগত রাখতে মোস্তাক অপচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের জড়িত ছিল বৈদেশিক ষড়যন্ত্রকারীদের সাহায্যপুষ্ট সামরিক বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ যার নেতৃত্ব দিয়েছিল মেজর রশিদ, মেজর ফারুক এবং বরখাস্তকৃত মেজর ডালিমসহ কয়েকজন জুনিয়র অফিসার। অভ্যুত্থানকারী সেনা অংশটি উর্ধ্বতন সামরিক মহলকে অবজ্ঞা করে বঙ্গভবনে অবস্থান করে এবং সেখান থেকে মোস্তাক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে এবং সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ জারি করতে থাকে। সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসারগণ অভ্যুত্থানকারী মেজরদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হন এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদেরকে নিরস্ত্র করার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। তখন সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং উপ-প্রধান ছিলেন খালেদ মোশাররফ। খালেদ মোশাররফই পাল্টা অভ্যুত্থান নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে মূলত দু’টি অভ্যূত্থান ঘটে। একটি ঘটে অভ্যূত্থানকারী অফিসার এবং খালেদ মোশাররফের মধ্যে এবং অন্যটি ঘটে খালেদ মোশাররফ এবং নওজোয়ান ও সিপাহীদের মধ্যে। প্রথম অভ্যূত্থানটি ঘটে ৩ নভেম্বর। এ দিন ভোরে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি মোস্তাকসহ বঙ্গভবন অবরোধ করে ফেলেন; বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র অবরোধ করেন; সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন এবং বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ফারুক-ডালিম গ্রুপটিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এ চক্রটি আত্মসমর্পণে অস্বীকার করে। তখন মোস্তাক সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ওসমানীর হস্তক্ষেপে দুই গ্রুপের মাঝে সমঝোতার প্রেক্ষিতে ফারুক-ডালিম গ্রæপের ১৫জন অফিসার ও ২জন এনসিও তাদের পরিবারসহ দেশত্যাগে রাজী হন। এ অবস্থায় মোস্তাক বুঝতে পারেন যে, তাঁর ক্ষমতাচ্যুতি অনিবার্য। তখন তাঁরই গোপন নির্দেশে এবং পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩রা নভেম্বর দিনগত রাত অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ভোর ৪টায় ডালিমের অনুগত দেশত্যাগী সৈন্যরা কারাগারে বন্দী চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্য করে; যাতে করে মুজিবের প্রকৃত অনুসারীরা আর ক্ষমতায় বসতে না পারে। ইতোমধ্যে খালেদ মোশাররফ জিয়াকে সামরিক বাহিনীর প্রধান থেকে চাপের মুখে পদত্যাগ করান এবং নিজে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ৪ঠা নভেম্বর মেজর জেনারেলে উন্নীত হয়ে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে বসেন। অতঃপর খালেদ মোশাররফ গ্রুপটি রাষ্ট্রপতি মোশতাককে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করে এবং ৫ নভেম্বর দিনগত রাত ১টায় অর্থাৎ ৬ নভেম্বর ভোরে প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। দ্বিতীয় অভ্যূত্থানটি ঘটে ৭ নভেম্বর। ৪ নভেম্বরে আওয়ামী লীগের শোক মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইয়ের অংশগ্রহণ; ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর-এই তিন দিনে খালেদ মোশাররফের সিদ্ধান্তহীনতা বা কোনো ঘোষণা না দেওয়ায় জনগণের মাঝে অস্থিরতা, জেনারেল জিয়াকে অপসারণ, মোস্তাক ও ওসমানীর পদত্যাগ, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের দেশত্যাগের ফলে জনগণ ও ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিকদের মাঝে আতংক, মুসলীম লীগ ও জাসদ কর্তৃক খালেদ মোশাররফকে ভারতের দালাল ও দেশদ্রোহী চিহ্নিত করে লিফলেট ছড়ানো এবং সর্বোপরি কর্নেল তাহের কর্তৃক সৈন্যদের বারো দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সিপাহী বিদ্রোহের ডাক- এ সকল কারণে ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে সৈন্যরা অস্ত্রাগার ভেংগে গোলাবারুদসহ খালেদ মোশাররফ-বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহে খালেদ মোশাররফসহ বহু অফিসার নিহত হন এবং বিদ্রোহী সিপাহীদের একাংশ গৃহবন্দী জিয়াকে মুক্ত করে। ৮ নভেম্বর Martial Law Proclamation-এর মাধ্যমে জিয়াকে সামরিক বাহিনীর প্রধান করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, বিচারপতি সায়েমই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ৬ নভেম্বর সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পর ৮ই নভেম্বর তিনি দ্বিতীয় সামরিক ফরমান The second Martial Law Proclamation জারি করেন। এই ফরমানের মাধ্যমে তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন; সংবিধানের ৪৮নং অনুচ্ছেদসহ ‘৬ষ্ঠ-ক’ ভাগ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন; অধ্যাদেশ প্রণয়নের শর্তহীন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং উপ-রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীপরিষদ বাতিল করলেন। ২৬ নভেম্বরে তিনি কিছু সামরিক অফিসার ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, ড. মো. ইব্রাহীম, কাজী আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক আবুল ফজল, ড. আব্দুর রশিদ, ড. এম এন হুদা প্রমুখ। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাইয়ে তিনি রাজনৈতিক দলবিধি জারি করেন এবং ইহার মাধ্যমে কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে জনগণকে রাজনৈতিক দলগঠনের অধিকার দেয়া হয়। আগষ্ট মাস থেকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি সামরিক ফরমান (3rd Martial Law Proclamation) জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে এবং নিজে শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে থেকে গেলেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন এবং জিয়াউর রহমান একই সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে অবতীর্ণ হলেন। উল্লেখ্য, যদিও সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন কিন্তু তাঁর শাসনের সকল চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ করেছেন জেনারেল জিয়া। সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কঠোরভাবে দমন ও অপসারণের পর নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে জিয়া প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি হলেন। জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে তার ক্ষমতার বেসামরিকিকরণ শুরু করেন।
Reference:
- * সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
- ১. শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা (ঢাকা: ঐতিহ্য, ২০১৪), পৃ. ৭৭। ৭১’র ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের জনসমুদ্রে জর্জ হ্যারিসনের উপস্থাপনায় কনসার্ট ফর দ্য বাংলাদেশ নামের যে চ্যারিটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয় তা আজো আমেরিকার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ চ্যারিটি কনসার্ট। জর্জ হ্যারিসনের কথা ও সুরে গাওয়া বাংলাদেশ নামের গানটির মাধ্যমে মুক্তিকামী বাংলাদেশ সারা বিশ্বের নিকট পরিচিতি লাভ করে।
- ২. শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, পৃ. ১৬৯।
- ৩. তদেব।
- ৪. হাজী গোলাম মোরশেদ। নামটি আমি প্রথম শুনি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর নিষেধ সত্তে¡ও তিনি নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার সাথে থেকে যান। ঐ কালো রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনিও ৩২ নং রোডের বাসগৃহ হতে কারাবন্দি হন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকাধীন মোরশেদ সাহেবের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি মুক্তি লাভ করেন ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১। ওনার উদ্যোগে ও অনুরোধে, ভারতীয় সেনারা বঙ্গবন্ধুর গৃহবন্দি পরিবারকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে মুক্ত করে, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। কিশোর বয়স হতে রাজনীতির সাথে জড়িত হাজী গোলাম মোরশেদের জীবন বর্ণাঢ্য ঘটনামালায় ভরপুর। বরেণ্য ও শক্তিধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন; সাক্ষী হয়েছেন এমন সব ঘটনাবলির যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভবিষ্যতের সত্যান্বেষী- বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচয়িতাদের ইতহাসকে আলোকিত করতে পারে। শারমিন আহমদ।
- ৫. শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, পৃ. ১৭০।
- ৬. তদেব
- ৭. সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ’র সাক্ষাৎকার, প্রাক্তন নিউজ এডিটর ও ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট, ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (এনা), ঢাকা, বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রকাশিত প্রথম নিয়মিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা প্রবাসী’র (১৯৮৫) প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বিস্তারিত: শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা (ঢাকা: ঐতিহ্য, ২০১৪), পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।
- ৮. তদেব, পৃ. ২০৩।
- ৯. তদেব। শারমিন আহমদ প্রণীত গ্রন্থের ২০৭নং পৃষ্ঠায় উল্লেখিত টীকা নং ৩ দ্রষ্টব্য। বেলাল মোহাম্মদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গ্রন্থের উল্লেখ সাপেক্ষে উক্ত বইটিও দেখা যেতে পারে।
- ১০. সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ’র ডায়েরি, শারমিন আহমদ, তদেব, পৃ. ২০৬-৭। ‘ডায়েরির অধিকাংশই ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সঙ্গতি রাখার জন্য ইংরেজিতে লেখা ঘটনা ও তথ্যাবলি বাংলা অনুবাদ করা হলো। কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ অনুবাদ ব্যতীত ব্যবহার করা হলো’ ইর্স্টান নিউজ এজেন্সি-এনার তৎকালীন সাংবাদিক ও নিউইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিক প্রবাসীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহর সঙ্গে কথা হলো। মোহাম্মদ উল্লাহ ভাই আমার জানামতে অত্যন্ত সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর কাছ থেকে কতগুলো তথ্য পেলাম যা লিখে রাখলাম ভবিষ্যতের জন্য। নিন্মে উল্লিখিত ৪ ও ৫ নম্বর-এ মোহাম্মদ উল্লাহ সাহেব আরও কিছু তথ্য যোগ করেছেন শারমিন আহমদ)।
- ১১. ব্যারিস্টার এম এ হালিম, সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ (ঢাকা: সিসিবি ফাউন্ডেশন, ২০১১), বিস্তারিত, মেজর রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ: সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট, পৃ. ৪৩-৪৫। Lawrence Lifschultz: Bangladesh: The Unfinished Revolution, p. 6-7. Anthony Mascarenhas: Bangladesh: A Legacy of Blood, p. 95-98.
- ১২. যেহেতু মার্শাল ল’ এর অধীনে সংবিধান বলবৎ ছিল সুতরাং ৫৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা স্পীকারের। কিন্তু ৬ নভেম্বর ভোরে অর্থাৎ সায়েম রাষ্ট্রপতি হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে মোস্তাক প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে (The Proclamation (Second Amendment) Order 1975)-এর মাধ্যমে সংবিধানের ৫৪নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পরিবর্তন করে প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বিধান করেন।

Associate Professor.
Department of Folklore, University of Rajshahi.