ড. মো. আমিরুল ইসলাম
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর (2013) ষাট বছরে পদার্পণ করলো। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক চিন্তা এবং আন্দোলনে অগ্রণী ছিল। বিশেষ করে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় সা¤প্রদায়িক সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক অঘোষিত কেন্দ্র ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। কলম্বো প্ল্যানের অনুমোনক্রমে দৃষ্টিনন্দন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা প্রণয়ন করেন অস্ট্রেলিয়ার লেঃ কর্ণেল জি সোয়ানী টমাস এম এ, তাকে সহযোগিতা করেন স্থপতি জন এ জিমানেক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গে বলতে গেলে এর প্রতীকটি মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই প্রতীক একই সাথে দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, উন্মুক্ত জ্ঞান এবং বৈশ্বিকতার প্রকাশকও। এর মোটিফ এবং রং এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে পরিস্ফুটিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এবং প্রাসঙ্গিকতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকে রয়েছে একটি বৃত্ত, একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ এবং গ্রন্থের মাঝখানে একটি আকাশদৃষ্টি শাপলা ফুল। গ্রন্থটি রক্তলাল ও সোনালি রংবিশিষ্ট দুটি বহিঃরেখা দ্বারা আবৃত। বৃত্ত বিশ্বের প্রতীক, গ্রন্থ জ্ঞানের প্রতীক, শাপলা ফুল সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও জাতীয় প্রতীক। শাপলা ফুল সূর্য অর্থেও প্রাণ ও শক্তির উৎস। বৃত্ত ও মূল গ্রন্থের রং কোবাল্ট ব্লু। তা আকাশ, নদী ও উদারতার রং। বাইরের রক্তলাল রং আমাদের জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তের প্রতীকের সাথে একাকার হয়ে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, মধ্যরেখার সোনালি রং সোনার মতোই মূল্যবান শিক্ষার গুণগত মূল্যের কথা বলে দেয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরবর্তী সময়ে রূপায়িত আমাদের স্বাধীনতা এবং জাতীয় ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা এই প্রতীকের মূল নকশা আঁকেন শিল্পী গোলাম সারওয়ার। কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে এটিকে চূড়ান্ত রূপ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং শিল্পী হাশেম খান।
১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাথে রাজশাহী শহরের গোড়াপত্তন এবং রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠিত না হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতো না। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সিভিলিয়ন ও মেলি সাহেব রাজশাহী জেলার গেজেটিয়ারে শিক্ষার যে করুণ চিত্র তুলে ধরেন তা থেকে পুরো উত্তরাঞ্চলের শিক্ষার দুর্দশার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। এই অবস্থার অবসানের লক্ষে তৎকালীন সরকার উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম জোরালো করার উদ্যোগ নেন। রাজশাহী শহর গড়ে ওঠে মূলত প্রাচীন রামপুর এবং বোয়ালিয়া নামক দুটি গ্রামকে কেন্দ্র করে। রামপুর-বোয়ালিয়া গ্রাম দুটি প্রসারিত হয়ে প্রথমে থানা এবং পরে জেলা শহরে রূপান্তরিত হয়। যদিও রাজা-বাদশাহদের ঐতিহ্যের স্মারক পদ্মা বিধৌত রাজশাহী ছিল প্রাচীন বরেন্দ্রভূমির প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু, রাজশাহী জেলা প্রতিষ্ঠার আগে নাটোর ছিল এ অঞ্চলের প্রধান প্রশাসনিক এবং ব্যবসা কেন্দ্র। ১৮৭৬ সালের হান্টারের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, নাটোরের আশেপাশের নদী-নালাগুলি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনসহ অন্যান্য অসুবিধা দেখা দেয়। জলাবদ্ধতার কারণে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পায় এবং ম্যালেরিয়া ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২৫ সালে নাটোর থেকে প্রশাসনিক কেন্দ্র রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে রাজশাহী একটি পূর্ণাঙ্গ শহর হিসেবে গড়ে ওঠার উপযোগিতা লাভ করে। নাটোর, পুঠিয়া, বলিহার, দিঘাপতিয়া, দুবলহাটি প্রভৃতি স্থানের রাজা-জমিদারদের আর্থিক সহায়তায় ও স্থানীয় জনসাধারণ, পেশাজীবী, ব্যবহারজীবীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় রাজশাহী একটি সমৃদ্ধ শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
রাজশাহীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৮২৫ সালে নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন পরবর্তী ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল কয়েক বছর চলার পরই বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৩৫ সালে জন অ্যাডাম্স শিক্ষা কমিশনের প্রধান হিসেবে রিপোর্ট তৈরির লক্ষ্যে সরেজমিনে শিক্ষা কার্যক্রম দেখার জন্য রাজশাহী-নাটোর-কলম প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করেন। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ১৮৩৬ সালে স্কুলটি পুনরায় চালু হয়। উক্ত রিপোর্টে রাজশাহীতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার ইংগিত করা হয়। নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ রায় কর্তৃক দানকৃত দেড় লক্ষ টাকা এবং রাজশাহী অঞ্চলের অন্যান্য রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজশাহী কলেজের পাঠদান প্রক্রিয়া চলতে থাকে। উলেখ্য, তৎকালীন পূর্ববাংলার সকল কলেজই তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। পূর্ববাংলার শিক্ষার প্রসার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতাও দোষ-ত্র“টি বের করে তার সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হন বিলেতের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ই এম স্যাডলার। যেহেতু, এ সময় সমগ্র বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহের মধ্যে রাজশাহী কলেজ ছিল শ্রেষ্ঠতম। কাজেই, স্যাডলার সাহেব বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে রাজশাহী কলেজকে একটি পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার সুপারিশ করেন। ১৯১৭ সালের এই রিপোর্টে রাজশাহীতে শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসার এবং উপযোগিতার প্রেক্ষিতে উক্ত সুপারিশ করা হলেও উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা এবং উদ্যোগের অভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত, বর্তমান খুলনা বিভাগও তৎকালে রাজশাহীর অধীনে ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার বিল নিয়ে তৎকালীন আইন পরিষদের সদস্যদের মধ্যেও মতভেদ দেখা দেয়। রাজশাহী কলেজের এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ এবং কমিশনের সুপারিশ থাকা সত্তে¡ও শুধু আইন পরিষদের সদস্যদের মধ্যে মত ভিন্নতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। একই সময়ে রংপুর এবং খুলনায়ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে থাকে। সেকালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ এবং খুলনা বি এল কলেজও শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজশাহী কলেজের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় ঐ এলাকার জনসাধারণের দাবিও বেশ জোরালো হয়ে উঠে। এই দুটি কলেজের অধীনে ছিল প্রচুর অব্যবহৃত ভূসম্পত্তি, তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা কঠিন ছিল না। রাজশাহী বিভাগের আইন সভার সদস্যদের মতভেদের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম এবং সিলেটেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে থাকে। তাছাড়া তকৎকালীন পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতৃবৃন্দের সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন না। নিজ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে ১৮৭৭ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত আলীগড় কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য তারা চাঁদা সংগ্রহ শুরু করেন। শওকত আলী, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্টজন স্বয়ং লর্ড হার্র্ডিঞ্জের সহায়তার জন্য দেড়লক্ষ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে পাঠান। এমনকি ১৯০৮ সালে নওয়াব আলী চৌধুরী মন্তব্য করেছিলেন, ‘অত্র প্রদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া কর্তব্য কিন্তু সে পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি।’ এই সুযোগে তৎকালীন সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। প্রকাশ থাকে যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে তা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। বঙ্গভঙ্গ রদ হলে পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ একদম ভেঙে পড়েন। নবাব সলিমুলাহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে স্বান্তনা দেবার জন্য ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় আসেন। তাকে (হার্ডিঞ্জ) মানপত্র প্রদানকালে সলীমুলাহ, ফজলুল হক, নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ এ দাবির পক্ষে সমর্থন জানান। ১৯১২ সালের ২ ফেব্র“য়ারি সরকারিভাবে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন বাবু ত্রৈলোক্যনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, বিপিন চন্দ্র পাল অম্বিকাচরণ মজুমদার, রাসবিহারী ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, আবুল কাসেম, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ মন্তব্য করেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে শিক্ষার অবনতি হবে। তারা মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলের সাধারণ গরিব কৃষক সন্তানেরা এখানে পড়তে আসবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে না। তারা এটিকে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে ঠাট্টা করতে থাকেন। এমনকি ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯২৭ সালে ৩০০ আসনবিশিষ্ট সলিমুলাহ মুসলিম হল স্থাপনকালে কেউ কেউ মন্তব্য করেন, ‘এখানে ৩০০ ছাত্র কখনোই হবে না, তাই এখানে গরু ছাগল থাকার জায়গা হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি সরকারের কাছে গৃহীত না হওয়ায় এ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ হতাশ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন পর ১৯৫০ সালের ১৮ অক্টোবর রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের ছাত্র ভর্তির সিলেকশন কমিটির সভায় রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম উচ্চারণ করেন। ঐ বছরের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী কলেজের কমনরুমে বর্ধিত এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য, আইনজীবী এবং রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান মাদার বখশের উপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দেন-দরবার করার দায়ভার অর্পণ করা হয়। ১৯৫১ সালে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন রাজশাহী আগমন করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। তিনি নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্র“তি দেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষাবিদ ড. জুবেরীকে বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত করেন। মশিউর রহমান যাদু মিঞা, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরীদের মতো পাকিস্তানখ্যাত নেতৃবৃন্দের কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এবারেও পিছিয়ে যায়। ১৯৫১ সালের ১ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার উন্নয়নকল্পে ১৮ টি প্রকল্পের জন্য প্রাদেশিক সরকারকে ২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের কথা বলা হলেও উপরোক্ত নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনড় থাকায় সরকারি প্রকল্পে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত কোনো উলেখ করা হয় না। মেডিকেল স্কুলের সভায় জুবেরী সাহেব মন্তব্য করেছিলেন যে রাজশাহী কলেজকে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা থেকে দুই লক্ষ টাকা বেশি দিলেই রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু কোনো বরাদ্দ না থাকায় রাজশাহীবাসী হতাশ হয়। ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে রাজশাহী ঈদগাহ মাঠের এক জনসভায় মাদার বখশ ঘোষণা করেন যে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা না হলে তিনি আইন সভা থেকে পদত্যাগ করবেন এবং উত্তরবঙ্গকে স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা দিবেন। তাকে রাষ্ট্রদোহী ঘোষণা করে গ্রেফতার করার সাত দিন পরে মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের সেক্রেটারী শাহ আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের এক সভায় রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয় এবং স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। ড. জুবেরী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত বিল ১৯৫২ সালের ১ নভেম্বর সংসদে উত্থাপিত হয়। ১৯৫৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবনমোহন পার্কের এক জনসভায় রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে মাদার বখশ, একরামুল হক, আবু হোসেন প্রমুখ ১৯৫৩ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন বর্ধমান হাউসে (বর্তমানে বাংলা একাডেমী) সাক্ষাৎ করেন। ৩১ মার্চ ১৯৫৩ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাশ হয়, ১৬ জুন প্রাদেশিক গভর্ণরের সম্মতিলাভ করে এবং উক্ত বছরের ৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ড. জুবেরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্তব্যরত থাকায় সেখান থেকে ইস্তফা দিয়ে ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে মাদার বখশকে নানামুখী বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে বাংলা, দর্শন, ইতিহাস, ইংরেজি, অর্থনীতি, গণিত, ভূগোল ও আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৬২ সাল থেকে সম্মান কোর্স চালু করা হয়। অস্থায়ীভাবে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়মূহ স্থাপিত হয়। পদ্মাতীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক বড়োকুঠির উপরতলায় উপাচার্যের বাসভবন এবং নিচতলায় উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারের কার্যালয় স্থাপন করা হয়। রাজশাহী কলেজ ভবনে (কলেজের ক্লাশ শুরুর আগেই) সকাল সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ চলতে থাকে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধবাদীরা বলতে থাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী কলেজেরই মর্নিং শিফট। কলেজিয়েট স্কুলের ফুলার হোস্টেলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রূপান্তরিত করা হয়। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন বাড়িতে গড়ে উঠে ছাত্রাবাস। বড়োকুঠি পাড়ার লালকুঠি ভবনে স্থাপিত হয় ছাত্রীনিবাস। শহরের বি বি হিন্দু একাডেমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, শিক্ষক লাউঞ্জ এবং চিকিৎসা কেন্দ্র। বড়োকুঠি পাড়ার মাতৃধাম ভবনে কলেজ পরিদর্শকের কার্যালয় এবং বাসস্থান, ঘোড়ামারা ডাকঘরের কাছে কুঞ্জমোহন মৈত্রেয়র জমিদার বাড়ির একাংশে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় স্থাপিত হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে বর্তমান ক্যাম্পাসে ভবনমূহ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে প্রয়োজনীয় বিভাগ ও দপ্তরসমূহ বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। মতিহারের সবুজ চত্বরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ৩০৩.৮০ হেক্টর। বর্তমানে ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৯টি বিভাগ এবং ৫টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মনে যে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা সঞ্চিত হয় এবং তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পেটোয়া বাহিনীর হাতে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্র“য়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহার নির্মম মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তা যেন গতি লাভ করে এবং স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, অধ্যাপক হবিবুর রহমান এবং অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম, ৯ জন ছাত্র, ৫ জন সহায়ক কর্মচারী এবং ১০ জন সাধারণ কর্মচারীসহ ২৭ জন শহীদ হন। বাংলাদেশে যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টিতে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মধ্যে অন্যতম। কালের পরিক্রমায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভের পর তাদের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে কর্মজীবনে দেশে ও বিদেশে আর্থ-সামাজিক, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গণে পথিকৃৎ হিসেবে গৌরবান্বিত করে চলেছে দেশ-জাতি-সমাজকে।

Associate Professor.
Department of Folklore, University of Rajshahi.