Abstract: Gazir gaan is one of the performing arts of Bengali folklore. The folk-culture and rural life lies in this folk drama traditionally. The present paper is an attempt brought forth on field collection at Gazir gan, from Khulna district, nearby sundarban. In this area Gazir gan contains such rituals and beliefs, which reflect the...
" />Abstract: Gazir gaan is one of the performing arts of Bengali folklore. The folk-culture and rural life lies in this folk drama traditionally. The present paper is an attempt brought forth on field collection at Gazir gan, from Khulna district, nearby sundarban. In this area Gazir gan contains such rituals and beliefs, which reflect the syncretistic tradition of Bengal forever.
১. ভূমিকা:
বাংলাদেশে গাজির গানের ব্যাপক প্রচলন এর জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করে। দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে খুলনা বিভাগের প্রায় সকল জেলাতেই গাজির গানের আয়োজন লক্ষ করা যায়। এ অঞ্চলের জনজীবনে গাজির গানের প্রভাব খুব বেশি। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করেই গাজির গানের বিস্তৃতি। গাজির গানের আলোচনা সুন্দরবন ছাড়া কিছুতেই পূর্ণতা পায় না। অতীতকালে সুন্দরবনের চারপাশের এলাকা ছিল জনবসতির জন্য প্রতিকূল। হিংস্র জীবজন্তু, মহামারী, সমুদ্র, নদী-খাল আর বাদাবন পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলের কৃষিজীবী, বনজীবী এবং জলজীবী মানুষের জীবন এবং জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল সুন্দরবন। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক প্রতিবেশই এদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হওয়ার কারণে প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব, প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা , বৈষয়িক উন্নতি, সমৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে এ অঞ্চলের জনজীবনে গাজি পিরের উপর নির্ভরতা। গাজি পিরের উপর ভরসা করেই এরা আজও রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হিংস্র কুমির এবং বিষাক্ত সাপের মোকাবেলা করে। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায় গাজি পিরের উদ্দেশ্যে পূজা, শিরনি, ওরস, মেলা প্রভৃতির আয়োজন করে থাকে। গাজি পির এ অঞ্চলের প্রধান লোকদেবতা। লোকসমাজের এই দেবতা বাঙালির জনজীবনে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীকও বটে। খুলনা অঞ্চলের ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে বাঙলাদেশের এই গাজির গানের প্রকৃতি ঊদ্ধারের চেষ্টা এই প্রবন্ধের মূূল লক্ষ্য।
২. গাজির গানের প্রসঙ্গ কথা:
হিন্দুসমাজে বাঘ দেবতা হিসেবে দক্ষিণা রায়ের যে স্থান মুসলিম সমাজে গাজিপিরের সেই স্থান। লোকপূজ্য পির গাজি দক্ষিণা রায়ের পর্যায়ভুক্ত হয়ে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজে পূজ্য হয়ে ওঠেন। জনজীবনের মু্িক্তদাতা এই পিরের গান তাদের ধ্যান ও জ্ঞানের উৎস। খুলনার দিঘলিয়া থানার দাসপাড়া নিবাসী অশীতিপর বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দাস বলেন, গাজীপিরই তাদের জীবনের ভালমন্দ, উন্নতি, অবনতি, ছেলে-মেয়ের বিয়ে, সুখ-শান্তি, সবকিছুর মাঝে অবস্থান করেন, বিধায় এ গান তাদের ধর্মেরই অংশ।১ এ গান অঞ্চলভেদে গাজির পালা, গাজির গীত, গাজির গাইন, পিরের গান, গাইনের পালা, গাইনেরগীত, গাইনের তামাশা ইত্যাদি নামে পরিচিত।২ হিন্দু মুসলিম উভয় পরিবারে গাজিপির সমান আসন দখল করে আছেন। নতুন সন্তানের জন্ম হলে গাজির গানের মানত করা হয়। এমনকি পরীক্ষা পাস এবং রোগমু্িক্তর জন্য গাজির গানের আসরের আয়োজন করা হয়। গাজিপিরের জনপ্রিয়তার কারণেই মৌখিক সাহিত্যের পাশাপাশি গাজি পিরকে ঘিরে লিখিত পুথি সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল বাংলা সাহিত্যে। গাজিপির বিষয়ক সবচেয়ে প্রাচীন পুথির রচনাকাল ১৭৯৮-৯৯ সাল। রচয়িতার নাম পাওয়া যায় কবি খোদা বখ্শ। সৈয়দ হালুমীর ১৮২৭, আবদুর রহিম ১৮৫৩, খোন্দকার মাহমুদ আলী ১৮৭৮, মোহাম্মদ মুন্সী ১৮৯৬ এবং আবদুল গফুর বিশ শতকের গোড়ার দিকে পুথি রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।৩ বর্তমান প্রবন্ধকার খুলনা বিভাগের জেলা সমূহে ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে লক্ষ্য করেন যে, গাজিপিরের পুথি এবং গাজিপিরের পালার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যদিও ধারণা করা হয় পুথি সাহিত্যের ছায়া অবলম্বন করেই পালা কাহিনী সমূহ রচিত হয়েছে। কিন্তু পালা সমূহ সংখ্যায় যেমন প্রাচুর্যের দাবিদার বিষয় বস্তুতে ও তেমনই বৈচিত্র্যমুখী। লোক সমাজ আপন জীবনের অনুকৃতির সাথে সাদৃশ রেখে নতুন নতুন পালা বা গাঁথা তৈরি করেছেন। প্রতিটি পালাতেই গাজিপির এবং কালুর উপস্থিতি থাকলেও ঘটনা এবং চরিত্রের বিস্তৃতির কারনে এর পালা সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। সরেজমিনে দেখা যায় যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ প্রভৃতি জেলায় প্রচলিত পালাসমূহের সাথে খুলনা জেলায় প্রচলিত পালাসমূহের ব্যাপক পার্থক্য। তবে উভয় অঞ্চলেই গাজি এবং কালুর উপস্থিতির সাথে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি এবং ঘটনার সন্নিবেশ কাঙিক্ষত মাত্রায় পাওয়া যায়। আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি ইহকালীন কল্যাণ এবং পূণ্য প্রাপ্তির অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সকল এলাকার লোক সমাজেই বিদ্যমান। তবে, সমগ্র বাংলাদেশেই গাজির সাতটি পালা সমধিক পরিচিত। পালাগুলো হলো :
১. গাজী-কালু-চম্পাবতীর পালা
২. নিজাম ডাকাতের পালা
৩. কাফন চোরার পালা
৪. ভেলুয়া সুন্দরীর পালা
৫. জামাল বাদশার পালা
৬. দিদার বাদশার পালা
৭. বাহরাম বাদশার পালা।
ব্যাপক এবং বৈচিত্র্য মূখী গাজির গানের সকল পালাতেই পাওয়া যায় মূখ্যত-
১. অধ্যাত্মবাদ
২. অসাম্প্রদায়িক চেতনা
৩. আনুগত্য
৪. আত্মসমর্পণ
৫. ইহকালীন কল্যাণ প্রভৃতি।
৩. গাজির আসনমানা:
হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে গাজিরগান শুরুর পূর্বে পূজার আয়োজন এবং আসন তৈরি করা হয়। বাড়ির উঠান বা কোন ফাঁকা স্থান পরিষ্কার করার পর মাটি দিয়ে লেপন করা হয়। স্থানটি শুকিয়ে গেলে সেখানে একটি কাঠের টুলের উপর একটি কুলা বা চালভর্তি প্লেট রাখা হয়। চালের উপর রাখা হয় মিষ্টান্ন বা চিনি, আলু, ধূপদানি, আগরবাতি, সিদুরের কৌটা, চামর প্রভৃতি । পাশে রাখা হয় আমপাতার ঘট। ঘটে জল রাখা হয় এবং সবুজ কচি আমপাতার পল্লব স্থাপন করা হয়। পাশে একটি পরিষ্কার মাদুরের উপর থাকে সঙ্গীত পরিবেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে হারমোনিয়াম, ঢোল, মৃদঙ্গ, মন্দিরা প্রভৃতি। এছাড়া অভিনয় কলার সাথে প্রয়োজনীয় কৃত্রিম চুল, দাড়ি, গামছা, জটা, ত্রিশুল, শাড়ি রঙিন কাপড় প্রভৃতিও থাকে। আসন সাজানোর পর সকলে একত্রে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে দু’হাত নামিয়ে প্রণাম জানায়। কখনো বা নামাজের মতো সিজদা করতে দেখা যায়। খুলনা অঞ্চলে তামা অথবা পিতলের তৈরি মাদারের প্রতিকৃতি লক্ষ করা যায়। যা আসনের সামনে পুঁতে রাখা হয়। এর উপরের অংশ অনেকটা মানুষের মুখমন্ডলের আকৃতি বিশিষ্ট এবং বিঘত পরিমাণ বা আধহাত প্রশস্ত। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত যত্নের সাথে এবং পবিত্রতা সহকারে করা হয়। এ সময় সকলকে কথা বলতে নিষেধ করা হয় এমনকি ছোট বাচ্চাদের মায়েরা কান্না থেকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করেন। চুল খোলা রাখতে নিষেধ করা হয় এবং মাথায় কাপড় বা ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়।
৪. বন্দনা:
আসন মানার পর ঢোলের আওয়াজের সাথে সাথে নিস্তব্ধতার অবসান ঘটে। শুরু হয় বন্দনা। বন্দনার মাঝে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় ঘটে। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, হিমালয়, সূর্যদেবী, ক্ষীরনদী সাগর প্রভৃতির বর্ণনা বন্দনার মাঝে প্রকাশ পায়। ময়মনসিংহ গীতিকার প্রচলিত পালা সমূহের সাথে গাজির পালার বন্দনারীতির সাদৃশ লক্ষনীয়। গাজির গানের মাঝে বর্ণিত ক্ষীরনদী সাগর-এর যে উল্লেখ, তা বাংলার নদ-নদী পরিবেষ্টিত ভূখন্ডকেই নির্দেশ করে। যথা-
পর্থমে উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত
তার ওপরে নাইতো কোন মানুষের বসত
পূবদিকে বন্দনা করি সূর্যদেবীর পায়
একদিকেতে ওঠে সূর্য্য চৌদিকে পর্সায়।
দক্ষিনে বন্দনা করি ক্ষীরনদী সাগর
সেই খানেতে চালায় তরী যত সাধুমহাজন
পশ্চিমে বন্দনা করি হজ্জ্ব মক্কার ঘর
সেইখানেতে নামাজ পড়লে বান্দার গুনা হয়রে মাপ
চাইরদিকে বন্দনা করে আসর করলাম ঠিক
মন দিয়ে শোনবেন আপনার
গাজি দুঃখের গীত।৪
প্রতিটি পালা পৃথক ভাবে পরিবেশিত হলে প্রারম্ভেই বন্দনা করা হয়। একই আসরে একাধিক পালা পরিবেশিত হলে প্রথম পালার শুরুতে বন্দনা করা হয়। উপস্থিত দর্শক এবং শ্রোতা সাধারন বন্দনারীতিকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে শ্রবন দর্শন করে থাকেন।
৫. গাজির গানের বিষয়বস্তু:
গাজির গানের প্রধান উপজীব্য বা বিষয় মূলত গাজিপির এবং তার ভ্রাতৃপ্রতিম সহচর কালু। যদিও কোথাও কোথাও কালুকে গাজির সহোদর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু খুলনা জেলায় প্রচলিত গাজির গানে এর সত্যতা পাওয়া যায় না। বর্তমান আলোচনায় লোক সমাজে প্রচলিত পালায় বর্ণিত ঘটনা এবং কাহিনীকেই প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। উত্তর দেশের বাদশা সিকান্দার শাহ, বিরাট শহরে তার বাস। বেগমের নাম নুরজাহান। একে একে জন্ম হলো তিনটি পুত্র। জুলফত, জনমদ্দি এবং দয়ার গাজি। (জুলফতকে কেউ কেউ জুলহাস বলে উল্লেখ করেন এবং রানীর নাম অযুফা বলে থাকেন)। জুলফত যৌবন প্রাপ্ত হলে রাজাপরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে শিকারে বের হন। ঘটনা ক্রমে এক মায়াবী রাজকন্যার সাক্ষাৎ পান এবং তাকে অনুসরণ করে পাতালপুরীতে গমন করার পর বিম্বিং রাজকন্যাকে বিয়ে করে সেখানেই অবস্থান করেন। পুত্রহারা মায়ের বুকে আর একবার শেলবিদ্ধ হয়। যখন দশবছর বয়সে গাজি সন্ন্যাস বৃত্তি গ্রহণ করেন। বাদশা সিকান্দারের সব নিষেধ অগ্রাহ্য করে গাজি ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে মুরর্শিদেরর পথ অনুসর করেন। মুরর্শিদের শর্ত মেনে সন্ন্যাসী হলেন গাজি। মুর্শিদের মাথার লাল পাগড়ির মাঝ থেকে একটি কালো সুতা বের করে তা দিয়ে হাওয়ার সাহায্যে কালুকে তৈরি করা হলো। কালুকে নিয়ে গাজি মায়ের কাছে গেলেন। কালুর মাঝে মা যেন হারানো ছেলে জুলফতকে খুঁজে পেলেন। মায়ের আকুতি দেখে কালু রাজপ্রসাদে থেকে যেতে চাইলেন। মায়ার বাঁধন কেঁটে কালুকে নিয়ে গাজি ফকির হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। গাজির গানে কালু একটি ব্যাঙ্গাত্মক চরিত্র। তির্যক বাকভঙ্গির মাধ্যমে সামাজিক অসঙ্গতি প্রকাশে কালুর ভূমিকা তুলনাহীন। শ্লেষাত্মক কথার মাধ্যমে সমকালীন দেশ এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি কালুর কথায় উঠে আসে। মূল কাহিনীর সাথে যোগ সূত্রহীন হলে ও আঞ্চলিক আর্থ সামাজিক এবং সমাজ সচেতনতার প্রকাশ এভাবেই গাজির গানে মূর্ত হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশটা চোরের খনি
সবই আমরা করতে পারি
চালচুরি, আটাচুরি, গরুচুরি
দরিচুরি, টাকাচুরি, ডালচুরি
সবাই আমরা করতে পারি
খেলার সময় খেলা করি
কাজের সময় চুরি করি
কোনটা আমরা কম পারি ?৫
গাজির গানের মাঝখানে ঠাট্টা মস্করামূলক অনেক প্রসঙ্গ আসে যা স্থানীয় ভাষায় ফাকরি বলে পরিচিত। কালুর কথার মাধ্যমে হাস্য রসাত্মক বিষয় সহজেই অনুপ্রবেশ করে। যথা: ওয়াইফ মানে ফরিবার, ইস্তিরি (স্ত্রী) মানে গাই। উপস্থাপনার মাঝে বর্তমান মানুষ ও জীবনধারা মূর্ত হয়ে ওঠে। গ্রামবাংলার মানুষ স্বভাবতই গমের ছাতু বা খুদের ভাত খায়। ফলতঃ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। কখনো বা অভাবের তাড়নায় গমের ভাত, আলুরভাত খায়। পেটেপীড়া দেখা দিলে তখন ওরস্যালাইন খেতে হয়। কালুর কথায় সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় না। জামাই শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে অভাবের সংসারে এসব খাবার খেয়ে যখন আক্রান্ত হয় তখন শুনতে পাই-
ছাতু খালাম মাতুখালাম
খালাম ক্ষিদের ঝালেরে
রাইত পোহাবার আগেরে প্যাটে
কুক ছাইরা দিয়া কান্দেরে
ডাইন হাতে জলের ঘটি
বাম হাতে লুঙ্গির কোচা
দর্মের দোহাই লাগেরে ছাতু
এই যাত্রা বাঁচা।৬
বউয়ের সাথে চাষীর কথোপকথনের প্রসঙ্গ গাজির গানের নজর এরায় না। অনেক সময় প্রাসঙ্গিক ভাবে স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনে মেয়েরা মারে-বাপরে উচ্চারণ করে। কালুর ভাষায়-
বাপ বাপ বলিস ক্যানরে
তোর বাপ গ্যাছে মাঠে
আমারে যে বাপ বলবে
সে যে তোর প্যাটে।৭
গাজির গানে মুরর্শিদি প্রসঙ্গ সহজেই অনুপ্রবেশ করে। চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে মূখ্যত গাজি, কালু, মুর্শিদ, রানী, দাসি, দাসির সখী, বাদশা প্রমুখকে পাওয়া যায়। বিশেষ করে মুর্শিদ এবং বাদশা চরিত্র নেপথ্যে থাকে। জানা যায় পাঁচ বছর বয়সেই পায় জুড়ি খেলার সময় গাজি ধ্যানমগ্ন হয়। এই বিশাল ব্রহ্মা-কে তার কাছে অসীম জলধি বলে মনে হয়। মৃত্যু রূপ সত্যকে সাথে রেখেই তাকে এই ভবসমুদ্র পার হতে হবে গাজির ভাষায়-
এই দুনিয়ায় হয়নি কায়েম
তাইতে করি ভয়
পিছে পিছে কাল সমন
আমার হয়েছে উদয়।
গাজি বনে গিয়ে মুর্শিদের সাধনায় দেওয়ানা হয়ে গেলেন-
হই ওরে মুর্শিদ দেখে যাও
তোমার ভক্ত দয়ার গাজি
কান্দিতে লাগিল
মুর্শিদ তুমি দেখে যাও।৯
মুশিদের মাঝেই খোদাকে পাওয়া যায়। মুর্শিদকে ভজনা করলেই খোদাকে ভজনা করা হয়। তাইতো গাজির কান্না শুনে স্বয়ং খোদা নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে জিবরাঈলকে প্রেরণ করলেন।
খোদা: হঠাৎ আমার অটল সিংহাসন টলে উঠছে কেন ?
জিবরাঈল: না জানি কোন প্রিয়ভক্ত স্মরন করছে, তাই অটল সিংহাসন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
খোদা: মর্ত্যরে মাটিতে গিয়ে আমার সেই ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করে দাও।
[ জিবরাঈল গাজির সামনে উপস্থিত হলেন ]
গাজি: তুমি কে ?
জিবরাঈল: আমি ভবপথের পথিক।
গাজি: ভবপথের পথিক যদি হও, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। যতক্ষন তোমার সাথে কথা বলব। ততক্ষন শতশত বার আমার দয়াল মুরর্শিদের নাম নিতে পারব।
জিবরাঈল: ও বুঝেছি। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি বালক! এই তোমার ভববক্ষু খুলে দিলাম।১০
এরপর অনেক কথোপকথনের মাধ্যমে জিবরাঈল নিশ্চিত হলেন গাজি কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। জিবরাঈল তখন মুরর্শিদ রূপে গাজির সামনে উপস্থিত হলেন। গাজিকে শিষ্যত্ব প্রদান করে আপন হাতে তুলে দিলেন হাতের আসা, পায়ের খরম, জায়নামাজের পাটা, মৃত্যু অংস পাখি। দক্ষিণের যে আঠারো ভাটি বাদা আছে তার মাঝে যত বাঘ, ভাল্লুক, দ্যাও দানব আছে গাজিকে সবার রাজা করা হলো। গাজির শরীরে চারটি অজপ্য গুণ দেওয়া হলো।
গুণ চারটি হলো-নির্ধনে ধন দান, নিপুত্রকে পুত্রদান, মৃতবৃক্ষকে জীবন দান এবং কামসিদ্ধি।১১
গাজির ভাষায়—
মুর্শিদ আমার মন বোঝেনা
একলা দুনিয়ায় ফকির হলাম
দোসর পেলাম না
আমি আসি বলতে পারি
যেতে বলতে পারি না
ও সাধের বেলা ডুবে গেলরে।
পাগলমন চেয়ে দেখালিনা
পুবের বেলা পশ্চিমে গেল
ভানু বসলো পটেরে।১২
সতীর্থ কালুসহ গাজি একদিন বিরাট শহরে অষ্টম দরজায় বাদশাহী মহলে ছদ্ম বেশে হাজির হলেন। দাসীর মাধ্যমে রানীমাতা ভিক্ষাদিয়ে পাঠালেন। কালু গাজি এই বলে জবাব দিলেন যে তারা ভিক্ষার ফকির নয়। দ্বারে দ্বারে মা খুঁজে বেড়ানোই তাদের কাজ। আসল উদ্দেশ্য ছদ্ম বেশে গাজি মাকে একবার দর্শন করে চক্ষু জুড়াবেন। অবশেষে রানী এসে তাদের পরিচয় জানতে চাহিলেন। কিন্তু চিনতে পারলেন না। কালুকে দেখে দাসীর মনে গাজির উদয় হলো—
আর এক কালো দতের কালি
যাতে পত্র লেখি
আর এক কালো চোখের মনি
যাদে দুনিয়া দেখি
আরেক কালো মাথারি কেশ
যাতে বেনী বান্ধে
আরেক কালো যমুনার জল
সর্বলোকে খায়
কালো কালো কৃষ্ণকালো
কালো চারটি বাত
মথুরাতে কৃষ্ণ কালো
কালো দীন নাথ।১৩
গাজীর মন মাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চায়না, সন্তান হারা মায়ের ব্যথাকে অনুভব করে গাজি গেয়ে ওঠেন-
আমি যাবনারে আমার মাকে ফাকি দিয়ে
আমার মাকে মা বলিবে আরতো কেহ নাই
নিশিও প্রভাতের কালে কারবা বাড়ি যাবে
কি করিব কোথায় যাব কোন বা পথে যাই
কোন বা পথে কাহারে আমার এ দুঃখ জানাই
পাড়ার লোকে ঢিল মারিবে আমার মায়ের গায়ে
ও ভাই আমি তো যাবনারে।
আমার শোকে মা যে পাগলিনী হবে
তুমি যাবা যাও কালু ভাই
তুমি তো কালাচান মায়ের উদরের নও
মায়ের দরদ বোঝনা।১৪
মা স্বপ্ন দেখে আপন সন্তানকে চিনতে পারলেন। ততক্ষনে গাজি কালু বিদায় হয়ে গেছেন। সন্তান হারানোর বেদনা মায়ের মনে নতুন করে জেগে উঠলো। পুত্রহারা শোকার্ত মা পাগলপারা হয়ে ছুটতে লাগলেন। মায়ের এই আহাজারি সমবেত নারী পুরুষকে কান্নায় ভাসিয়ে দিল।
রানীর ভাষায়-
ঐ ওরে বিধি কি জানি লিখিলি কপালে
নীলমনি হায়রে গোপালহারা হলাম আমি
ঐখানেতে খেলতো গাজি সোনার বাটা হাতে
কোন হারানি হেরে নিল তারে পেয়েরাজ পথে
কেনবা বিধি করে ছিল কালুগাজির মা
গাজী কালার মা হয়ে মনের বাঞ্চা মেটেনা
এভাবে যার হয়নি পুত্র যে জন আছে বলো
ওহে পুত্র ছেড়ে গেল কানতে জনম গেল
কারবা আমি ছিড়েছিলাম ভরাক্ষেতের বাইন
সেতো মোরে দিয়েছিল পুত্রশোকের গাইন
কারবা আমি ছিড়েছিলাম খন্ড কলার পাতা
সেই তো মোরে দিয়েছিল পুত্র শোকের ব্যথা।১৫
রানীর কণ্ঠে যেন চিরন্তন বঙ্গমাতার পুত্রশোকের বিলাপ শুনতে পাওয়া যায়। গাজি পির বাঙালি হিন্দু মুসলমানের দেবতা। মানুষ চিরকালই একটা অবলম্বনকে আশ্রয় করে বেঁচে আকতে চায়। যূথ অরণ্যচারী জীবনে দক্ষিণ বাংলার মানুষের যে সংগ্রাম তার মাঝে গাজিপির তাদের ত্রাতা স্বরূপ।
গাজিপীর তাদের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকায় প্রেরণা হয়েছেন। সুন্দর বনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও গাজিপিরের মূর্তি শোভা পায় গাজির গানে সবচেয়ে জনপ্রিয় উপাখ্যান মুকুট রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে গাজি কর্তৃক তার মেয়ে চম্পাবতীকে বিয়ে করার কাহিনী।
৬. গাজির ভোগ:
সুন্দর বনে প্রবেশের আগে বাঘের হাত থেকে রক্ষার জন্য গাজির উদ্দেশ্যে ভোগ দেওয়া হয়। বাওয়ালি সম্প্রদায় মধু সংগ্রহের আগে গাজিপিরকে স্মরন করে পূজা আচার পালন করে থাকেন। গাজি পিরের উদ্দেশ্যে হাস-মুরগি ছেড়ে দেওয়া হয়, পাঠা বলি দেওয়া হয়। কখনো বা পাড়া গ্রামে গাজির নামে চাল উঠিয়ে শিরনি করা হয়। খিচুরি বা পায়েস রান্না করে গাজির উদ্দেশ্যে ভেট প্রদান করার পর সবাই মিলে মিশে খায়। হিন্দু-মুসলমান একত্রে এই ভোগ দেওয়া বা শিরনির আয়েজন করে থাকে। বাঘের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই শিরনি পালন করা হয় বলে কেউ কেউ একে বাঘাইর শিরনি বলে উল্লেখ করেছেন। ওয়াকিল আহমদ উল্লেখ করেন যে, বাঘাই পীরের শিরনি উপলক্ষে যে মাঙন হয় তাতে গ্রামের রাখাল বালকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছড়ায় বাঘের বয়ান গায় ও চাল ডাল সংগ্রহ করে।
৭. গাজির বাঁশ নাচানো:
বাঁশ শব্দটির সাথে বংশবৃদ্ধির সাদৃশ থেকে কেউ কেউ মনে করেন যে গাজির বাঁশ নাচানো উৎসব পালন করলে বংশ রক্ষা হয়। নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান লাভের বাসনায় এই আচারে আয়োজন করে থাকেন। ধারণা করা হয় এর ফলে বাঁশের ঝাড়ের নতুন বাঁশ বৃদ্ধির ন্যায় পরিবারে পুত্র সন্তানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। খুলনা জেলায় বাঁশ বিয়ের প্রচলন আছে বলে গাজি গানের শিল্পী শাহাদত হোসেন মন্ডল উল্লেখ করেন। তার মতে বাঁশ নাচানোতে দক্ষ ব্যক্তি বেশ পরিশ্রম করে থাকেন। এ উপলক্ষে বিশেষ থান বা দরগা তৈরি করা হয়। বাঁশের গাঁয়ে রঙিন কাপড় জড়িয়ে কৃত্রিম চুল লাগিয়ে দরগার চারপাশে নাচানো হয়। এতে মানতকারীর মনো বাসনা পূর্ণ হয় বলে প্রচলিত আছে। ওয়াকিল আহমদের বর্ণনা থেকেও আমরা গাজির বাঁশ দেওয়া বা বাঁশ নাচানোর সত্যতার উল্লেখ পাই। ওয়াকিল আহমদ বলেন, অনুষ্ঠান টিকে রূপ দেওয়ার জন্য পেশাদার নাড়া ও চেলা আছে। মানতকারিণীর আহ্বানে তারা গাজির দরগায় উপস্থিত হয়। এই দরগাটি তৈরি করায় মানতকারিণী নিজেই। একটা খোলা মেলা উচুঁ জায়গায় লেপে পুছে গাজির দরগা তৈরি করা হয়। দরগার সামনে তিনটি বাঁশ পোঁতা থাকে, মাঝের বাঁশটি অপেক্ষাকৃত লম্বা। এটাই গাজিপীরের প্রতীক বাঁশ। বাঁশ গুলির মাথায় চামর বাঁধা থাকে। অনুষ্ঠানের দিন ঠেঁলা গাজির বাঁশটি মাটি থেকে তুলে নাভির উপরে রেখে দরগার চার পাশে নাচের ভঙ্গিতে, সাতবার প্রদক্ষিন করে। সেই সাথে ঢুলি ঢোল বাজায় এবং নাড়া প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গাজির মহিমা বর্ণনা করে।১৬
গাজির বাঁশ নাচানোর সাথে মাদারের বাঁশ নাচানোর বেশ সাদৃশ লক্ষ করা যায়। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক তাঁর আত্মজীবনী মূলক রচনার প্রথম খন্ড ‘ ফিরে যাই ফিরে আসি ’তে মাদারের বাঁশ নাচ উৎসবের সরস বর্ণনা দিয়েছেন। তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং সরাসরি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে মাদারের বাঁশ নাচ এবং গাজির বাঁশ নাচের পার্থক্য জানা যায়। মাদারের বাঁশ নাচে পুরুষ মাদার এবং নারী মাদার থাকে। পুরুষ মাদারের রং হয় নীল সাদা এবং নারী মাদারের রং হয় লাল সাদা। তাছাড়া মাদার নাচের সময় একটা বড় তামার পয়সা তালুর উপর রেখে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে তার অর্ধেকটা পরিমাণে মাদার বাঁশকে বসিয়ে নাচানো হয়। অপরদিকে গাজির নাচে বাঁশকে নাভির উপর বসিয়ে নাচানো হয় যা বেশ কষ্টসাধ্য। উভয় নাচের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে একই।১৭
৮. গাজির বাঁশ বিয়ে:
ওয়াকিল আহমদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এক সময় গাজির বাঁশের সাথে মানব কন্যার কৃত্রিম বিবাহ দেওয়া হতো। সাধারণত, মৃত বৎসার কন্যা সন্তান হলে সেই কন্যার সাথে বাঁশ বিয়ে দেওয়া হতো। তবে ঐ কন্যাকে ফকিরি জীবন যাপন করতে হতো। এছাড়া সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করে ও এ আচার পালন করা হতো। এর সাথে বাঙালির উর্বরতা তত্তে¡র নৃতাত্তি¡ক বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত।
মানত করার পর যদি কোন সন্তান জন্মে তবে বাঁেশর সাথে বাঁশেরই কৃত্রিম বিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবছর ১০ জৈষ্ঠ এর উদযাপন কাল বলে মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘ হারামণি’ তে উল্লেখ রয়েছে। এ উৎপলক্ষে বাঁশটিকে লাল কাপড় ও ফুলদিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। বর্তমানে এই আচারটি বিলুপ্ত প্রায়।
৯.উপসংহার:
রওশন ইজদানী গজির গানকে লোককৃত্যমূলক গান অভিধায় ভূষিত করেছেন। গাজির গানের সাথে যুক্ত শ্রোতা এবং গায়েন স¤প্রদায় সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর। এরা সমাজের বিত্তবানদের, কাছে যেমন-অবহেলার পাত্র তেমনই নিপীড়িত। প্রকৃতি এবং জীবনের কাছে এরা এতটাই অসহায় যে, অতিলৌকিক কোন শক্তির নিকট আশ্রয়গ্রহণ ছাড়া এদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে জনসাধারণ পার্থিব বিপদমুক্তির জন্য গাজি পিরের উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে। সে অর্থে গাজিপির তাদের ধর্মসমন্বয়ের দেবতার আসন গ্রহণ করেছেন। গাজির উদ্দেশ্যে নিবেদিত পূজা বা বন্দনায় দেবতাতুষ্টির অনুকরণ লক্ষ করা যায়। আঠারো শতক, উনিশশতক এবং বিশশতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই গাজির গান জনপ্রিয় ছিল। এই সময়কার বাংলাদেশে গ্রামীণ মুসলমান সমাজের ধর্মজীবন ছিল ব্যাপকভাবে লৌকিক ধর্মবিশ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই সমাজে লৌকিক ধর্মবিশ্বাসের এতোটা প্রভাব ছিলো যে, কখনো কখনো হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্য অভিন্ন লৌকিক দেবতার উপস্থিতি ও লক্ষ করা যায়। সত্যনারায়ণ বা সত্যপির এমন এক দেবতা। একই কারণে গাজির কাহিনীতে যথেষ্ট পরিমাণে সা¤প্রদায়িক উপসর্গের উপস্থিতি থাকা সত্তে¡ও মুসলমান সমাজের ন্যায় হিন্দু সমাজে ও বিপদে আপদে গাজিকে স্মরন বা গাজির গানের মানত করার রেওয়াজ আজও প্রচলিত। গাজির গান নিম্ন বিত্ত হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমিয়ে দিয়েছে। গাজির গানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তবান হিন্দু বা মুসলমান কেউ এগিয়ে আসেননি। নিম্ন বিত্তরাই শ্রোতা ও পৃষ্ঠপোষক। গায়েনদের কেউ এ গানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। কৃষিজীবী, রিকশাচালক, কারখানার শ্রমিক, দোকানি, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, চিংড়িঘেরের শ্রমিক, নৌকার মাঝি, জেলে, তাঁতি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রভৃতি পেশার সাথে যুক্ত গাজির গানের গায়েন ও পৃষ্ঠপোষকবৃন্দ।২৩ গাজির গানের শ্রাতাদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের লোকের সমাগম ঘটে। জনসংখ্যাধিক্যের কারণে মুসলমান পরিবারের শ্রোতাসংখ্যা বেশি। অবশ্য প্রতিটি দলেই গায়েনদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম সংমিশ্রণ চোখে পড়ার মতো। কোথাও কোথাও মূল গায়েন হিন্দু স¤প্রদায় ভুক্ত এবং পাশ্বচরিত্র সমূহ মুসলিম সমাজ থেকে আগত। তবে সবচেয়ে বেশি লক্ষনীয় বিষয় হলো বাদকদের অধিকাংশই হিন্দু পরিবার থেকে আগত। ঢোল, বাঁশি, চাটি, মন্দিরা প্রভৃতি বাদকবৃন্দ হিন্দু পরিবারের সদস্য।
দিঘলিয়া’র দাসপাড়ায় লক্ষ করা গেছে যে, পালা উপলক্ষে হিন্দু-মুসলিম একই পরিবারে একত্রে খাবার গ্রহণ করেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দাসের বাড়িতে দেখেছি সকল গায়ক তার বাড়িতে দুপুরের খাদ্য গ্রহণ করে একত্রে বিশ্রাম করছেন। এখানে কোনজাত বা সম্প্রদায়গত ব্যবধান সামনে আসেনি। শ্রোতাসাধারণ গাজিপিরকে অতিলৌকিক ক্ষমতার আধার বলে মনে করেন। তাদের বিশ্বাস গাজি সর্বত্রগামী। রূপ-রূপান্তর বা অশরীরী মূর্তি ধারণ করতে পারেন। প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে দৈবদুর্র্বিপাক থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেন। এমনকি মৃত ব্যক্তি এবং বৃক্ষকে পুনরুজ্জীবন দান করার ক্ষমতাও তার রয়েছে। তারা এমন ধারণা পোষণ করেন যে গাজিপির তাদের মনের কথা জানেন এবং ভবিষ্যতের কথা বলে দিতে পারেন। তার দোয়ায় নিঃসন্তানের সন্তান লাভ, অন্ধের দৃষ্টিঅর্জন, রোগীর রোগমুক্তি ক্ষুর্ধাতের ক্ষুধা নিবৃত্তি, পীড়িতের সেবালাভ এবং শস্ত্রকে জয় করা যায়। তারা আরও বিশ্বাস করেন, গাজি পির আগুন পানির উপর কর্তৃত্ব করে সকল মঙ্গলের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন। গাজিপিরের গানকে তারা পূণ্য অর্জনের উপায় হিসেবে দেখে থাকেন এবং মনে করেন এগানের পরিবেশনার সাথে যুক্ত থাকলে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তিলাভ হয়। গাজির গান যেমন বাঙালির জনজীবনে মুক্তির আকাঙ্খা জাগায় তেমনি তাদের আনন্দ বিনোদনের প্রকাশ ও ঘটে এর মাঝে। কাজেই এ গান বাঙালি হিন্দু মুসলমানের জনজীবনের স্পন্দন।
গাজির গান বাঙালির চিরায়ত লোকনাট্যের ঐতিহ্যকে ধারন করে এগিয়ে চলে। এর মাঝে পাওয়া যায় কাহিনি, অভিনয় কুশলতা, সংলাপ, কাব্যময় সঙ্গীত এবং কৌতুকপ্রিয়তার সমন্বয়। সাধারণ মানুষের জীবন ভাবনাকে অনুসরন করে কাহিনীর চরিত্রের সুখ-দুঃখের সাথে একাকার হয়ে যায় বাঙালির জীবন। দুঃখ দারিদ্র্যক্লিষ্ট একঘেয়ে জীবনের পীড়ন এবং যন্ত্রনা থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের একটি আশ্রয়স্থল এগান। মানত এবং পুণ্য অর্জনের পাশাপাশি আনন্দ উপভোগও এখানে মুখ্য। প্রাত্যহিক কর্মজীবনে এভাবে গাজিরগান প্রভাব ফেলে মানবচিত্তকে জয় করে থাকে। বাঙালীর শিক্ষা ও শাস্ত্র জ্ঞানের গভীরতার যে অপূর্ণতা সে অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করে দেয় উদার চিত্ত ও সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থান। তাইতো এ জাতির লোকসঙ্গীত, পালাগান, ছড়া, বিশ্বাস-সংস্কার, প্রবাদ প্রবচন, কিংবদন্তি, ব্রত কৃথা প্রভৃতির মাধ্যমে নিজস্ব চিন্তার প্রকাশ ঘটে। রোগ শোকপীড়িত ও অভাব অূনটনের মাঝে সেবা, সাহায্য, অনুগ্রহ কামনায় গাজির গানকে অনুষঙ্গ বিবেচনা করে বাঙালি, আর এভাবেই গাজিরগান হয়ে ওঠে জনজীবনের অনুকৃতি।
Reference:
১. ধীরেন্দ্রনাথ দাস-এর সাক্ষাৎকার। গাজীপীরকে তিনি দেবতা বলে সম্বোধন করেন। সাক্ষাতকারের তারিখ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০১।
২. স্বরোচিষ সরকার, “লোকনাট্য গাজির গান: শৈল্পিক স্বাতন্ত্র্য ও প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা”, আইবিএস জার্নাল, ১২শ সংখ্যা ১৪১১ (২০০৫), পৃ. ১১১।
৩. তদেব, পৃ. ১১২।
৪. সাক্ষাতকার: রমজান আলী শেখ, বয়স-৪০, গ্রাম-দাসপাড়া, দিঘলিয়া সদর, খুলনা। তারিখ:১৪ সেপ্টেম্বর ২০১০।
৫. সাক্ষাতকার:মন্টু চন্দ্র দাস, বয়স-৪৫, দাসপাড়া, দিঘলিয়া, খুলনা।তারিখ :১৪ সেপ্টেম্বর ২০১০, তিনি এ ধরনের গানকে ফাকরি বলে উল্লেখ করেন। এর মাধ্যমে দর্শক চিত্তকে আনন্দ প্রদান করা হয়।
৬. সাক্ষাতকার: রমজান আলী শেখ ।
৭. তদেব।
৮. তদেব।
৯. তদেব।
১০. তদেব।
১১. তদেব।
১২. তদেব।
১৩. সাক্ষাতকার: মন্টু চন্দ্র দাস ।
১৪. তদেব।
১৫. সাক্ষাতকার: মন্টু চন্দ্র দাস ।
১৬. ওয়াকিল আহমদ, বাংলার লোক-সংস্কৃতি (ঢাকা: গতিধারা, ২০০১), পৃ. ২১২।
১৭. সাক্ষাতকার: হাসান আজিজুল হক, তারিখ: ১৫ জুন ২০১০, আইবিএস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।
শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আপনার অসমান্য তথ্যসমৃদ্ধ গাজীর গান বিষয়ক প্রবন্ধটি পড়লাম । ঋদ্ধ হলাম। বিনম্রতা সহ জানাই বাংলার হারিয়ে যাওয়া বা লুপ্তপ্রায় গান নিয়ে আমার পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা করছি। যে কোন লুপ্তপ্রায় গান নিয়ে আপনার একটি গবেষণা ধর্মী লেখা চাইছি। আগষ্টের ৩০, ২০১৮ মধ্যে পাঠালে ভালো হয়। সংখ্যাটি নভেম্বর ২০১৮ প্রকাশিত হবে। লেখা পাঠাবেন-prodipmandal79@gmail.com / atmashakti2@gmail.com এ। ধন্যবাদ।—প্রদীপ মণ্ডল, সম্পাদক–আত্মশক্তি, শিমুলপুর (দক্ষিণ), পোঃ ঠাকুরনগর, উত্তর ২৪ পরগণা-৭৪৩২৮৭, মোঃ ৯৪৩৪৪৪৫৬৭৫।
Thanks,
bro Prodip mandal, I shall contact you timely.