কনক আমিরুল ইসলাম
‘ঔপন্যাসিক এবং সমালোচক ভার্জিনিয়া উলফ্-এর ধারণা একজন প্রথম শ্রেণির কথা সাহিত্যিক সমস্ত পট নিজে ভরে ফেলেন না। পাঠককে কাহিনীর অন্তরালে আর এক কাহিনী আবিষ্কার করতে … গড়ে তুলতে দেন। পাঠকের কল্পনার জন্য সক্রিয় কিছু রেখে দেন। অবশ্যই দ্বিতীয় কাহিনীকে প্রথম লিখিত কাহিনীর অন্তরালে থাকতে হবে। বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লে শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেললে, লেখারই কোনো অর্থ থাকবে না। লিখিত আর অলিখিত কাহিনীর সুক্ষ্য গ্রন্থন লেখক আর পাঠকের মেলবন্ধনকে দৃঢ় করে।১ মধ্যাহ্ন উপন্যাসের ভূমিকায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহানবোধ, (!) এইসব অতি প্রয়োজনীয় (?) বিষয়গুলি এসেছে কি আসেনি তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। ইদানিং আমার মনে হয়, আমার কোনো সমস্য হয়েছে। হয়তোবা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়, চেষ্টা করে দেখিনা সময়টাকে ধরা যায় কি না। … আমি ইতিহাসের বই লিখছিনা। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তারপরেও …।২
হুমায়ূন আহমেদের উপরোক্ত কথার মধ্যদিয়েই তার লেখক সত্তার জবাবদিহিতা এবং মনোভাব সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানা যায়। মুক্তভাবে দুহাত ভরে লিখে তিনি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তার যে কোনো লেখাই একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে কোনো পাঠকই উঠতে পারেন না। যত সিরিয়াস পাঠকই হোননা কেন, কৌতূহলবশত হুমায়ূনের কোনো লেখা পড়তে শুরু করলেও তার পক্ষে শেষ না করে উপায় থাকে না। তার লেখার সবচেয়ে বড়ো শক্তি, তার গল্প বলার ভঙ্গি। অনেক সিরিয়াস পাঠকেরই অভিযোগ, ‘হুমায়ূন আহমদের লেখায় যাদু আছে, কিন্তু একবার পড়ে শেষ করার পরে তাতে মনে রাখার মতো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না’। হুমায়ূন আহমদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কথোপকথন এবং দেয়াল উপন্যাস থেকে জানা যায়, জীবনের প্রথম দিকে তিনি একজন নাম করা ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের নানা প্রান্তে ম্যাজিক শো করে সুনাম অর্জনের পাশাপাশি অর্থ উপার্জনও করেছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যাদুশিল্পী জুয়েল আইচের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক জাদুশিল্পী সংস্থার সদস্যপদ অর্জন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও শেষাবধি সদস্য হননি। ফুলশয্যার রাতে নববধূর (গুলতেকীন) সামনে ম্যাজিকের কৌশল ধরা পড়ায় জীবনে আর কোনো দিন ম্যাজিক দেখানোর চেষ্টাও করেন নি। কিন্তু আমরা পরবর্তীতে লক্ষ করি যে তার গদ্যের ভাষায় ম্যাজিক ছিল। যা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করতো, নেশার ঘোরে ডুবিয়ে রাখতো। পৃথিবীতে এমন ঘটনা বিরল, নাটকের চরিত্রের ফাঁসির আদেশ প্রত্যাহারের জন্য রাজধানীসহ দেশজুড়ে টানটান উত্তেজনা, আন্দোলন-মিছিল। তার নাটক, চলচ্চিত্র, গল্প, উপন্যাস, গীতরচনা সবছিুতেই ভাষা প্রকাশের যাদুময়তা কাজ করতো। তবে জীবনের পরিণত প্রান্তে এসে তিনি বস্তুনিষ্ঠ (?) লেখক হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অনেকটা সফলতাও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু মুক্ত হুমায়ূন এখান থেকেই যেন মৃত্যুবরণ করলেন। তখন পূর্ববর্তী রচনার যে গতিময় ভাষা, তা আর রইল না। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে হুমায়ূন তার জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্তও বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। তাকে অতিক্রম করার মতো ভাষা নিয়ে কেউ হাজির হতে সক্ষম হন নি বলেই তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। এবং আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু শুরুর দিকের হুমায়ূন এবং শেষের দিকের হুমায়ূনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখানে হুমায়ূনের কাছে হুমায়ূন নিজেই পরাজিত। তার সর্বশেষ উপন্যাস দেয়াল নিয়েই বর্তমান প্রবন্ধের অবতারণা।
আনিসুজ্জামানের ভূমিকাসম্বলিত সপ্তম মুদ্রণ যখন প্রকাশিত, হুমায়ূন আহমেদ তখন দেয়ালের অপর প্রান্তে। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে হুমায়ূন আহমেদ জীবন এবং মরণের মাঝেও একটি দেয়াল নির্মাণ করে এভাবে প্রস্থান করবেন, তা তার পাঠকের কল্পনায়ও ছিল না। পাঠকের প্রস্তুতি যেমন ছিল না, হুমায়ূনকে বিদায় দেবার মতো বিকল্পও ছিল না বাঙালির। আর কোনা দিন হুমায়ূনের বিকল্প তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান প্রতিটি বাংলা অনুরাগী পাঠক। হুমায়ূনের ঘোরতোর বিরোধীরাও এ কথা স্বীকার করবেন। পাঠকের কল্পনাকে সম্পূর্ণ দেয়ালের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিনি নেপথ্যে চলে গেলেন। এই দেয়াল জীবন এবং মৃত্যুর, শুভ এবং অশুভের, স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের। যে দেয়াল বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা এবং স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথে চির বিভক্তি এবং বিভ্রান্তির বিমূর্ত রূপ; তার আরম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট শুরু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু সরকার, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল-শাসন, পঞ্চম সংশোধনী এবং জিয়াউর রহমানের হত্যা, জেনারেল মঞ্জুর হত্যা পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। দেয়ালের পটভূমি দেখে মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ এক বিশাল প্রকল্পনা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তাকে হয়তোবা প্রকাশকের চাপে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পরিধি সংক্ষেপ করতে হয়েছে। কিংবা বিষয়টির সূচনা মাত্র করেছিলেন তিনি। আনিসুজ্জামানের ভূমিকায় ব্যক্ত আশাবাদের প্রতিফলন ঘটেছে দেয়ালে। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দেয়াল। হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য লেখার মতোই দেয়ালের উপরও হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পাঠক। এখানেই হুমায়ূন অনন্য, অনন্যতা তার ভাষার সরলতা এবং বাককুশলতার। গোলাম মুরশিদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কথা দিয়েই বলব, ‘বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের একটা ভাষা নিয়ে এসেছিলেন হুমায়ূন’। সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন ‘হুমায়ূন আহমেদের চোখ গল্পটি পৃথিবীর সেরা দশটি গল্পের একটি’।৩ বাংলা একাডেমি বাংলা বিবর্তনমূলক অভিধান সংকলনের সময়ে আমেরিকায় হুমায়ূন আহমদের চিকিৎসা চলাকালীন প্রতি দিনের সর্বশেষ খবর আমরা পেতাম মুরশিদ স্যারের মাধ্যমে। স্যার খবর পেতেন পুরবী বসুর কাছ থেকে। পুরবী বসু হুমায়ূন আহমদের চিকিৎসাকালীন পাশে ছিলেন। মুরশিদ স্যার ঢাকায় থাকাকালীন শুনে নিতাম হুমায়ূন আহমদের প্রতিদিনের অবস্থা। স্যার লন্ডনে থাকলে স্কাইপেতে আমাদের কাজের অগ্রগতির কথা জানানোর পাশাপাশি হুমায়ূন আহমদের কথাও জেনে নিতাম প্রতিদিন।
হুমায়ূন আহমদের দেয়াল ঐতিহাসিক উপন্যাস কি না এরকম প্রশ্ন সচরাচর কানে আসে। কিন্তু লেখক যখন স্বগতোক্তি করেন, তিনি গল্প বলছেন, ইতিহাস রচনা করছেন না। তখন, এ ধরনের তর্কের অবতারণা বৃথা। লেখক যখন পাঠকের কোর্টে বল ছুড়ে দেন, তখন তা নিয়ে পাঠক ইচ্ছে মতো খেলতে পারে। লেখকের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। দেয়াল নিয়ে খেলা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বল ছুঁড়ে দিয়েছেন কোর্টে, পাঠক এবং বৃহত্তর সমাজের এখন খেলার পালা। একজন পাঠক একটি বিশেষ বইকে পছন্দ বা অপছন্দ যা খুশি করতে পারে। মাথায় তুলে নাচতে বা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। বুঝতে বা না বুঝতে পারে, লেখককে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের ইচ্ছামত টেক্সট ঢেলে সাজাতেও পারবে। কিন্তু ‘রিডার রিসপন্স’ ও ‘রিসেপসন থিওরি’ মানতে গেলে মনে রাখতে হবে লেখক, পাঠক ও পাঠের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বেশ বদলেছে। টেরি ঈগল্টন দেখিয়েছেন কোনো লেখক প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয় তথ্য সরাসরি জানিয়ে দেন না। সব লেখাতেই কিছু শুন্যস্থান থাকে। সেখানে পাদপূরণের ভার পাঠকের, এটা ধরেই নেওয়া হয়। আবার পাঠক যেভাবে পাদ পূরণ করবেন, নীরবতাকে ভরিয়ে তুলবেন, তা ব্যক্তিগত রুচি ছাড়াও অনেকাংশে নির্ভর করবে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের উপর। অর্থাৎ, টেক্সট নামক বল নিয়ে তিনজন খেলোয়ার মাঠে নেমেছে। লেখক, পাঠক ও বৃহত্তর সমাজ। কোনো কোনো সাহিত্যিক একেবারে ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করে পাঠকের কোর্টে বল ছুঁড়ে দেন। অর্থাৎ কাহিনীর একাধিক সম্ভাব্য পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে পাঠককে তার মধ্যে বেছে নিতে বলেন। একে বলা যায়, ‘রিডার রিসপন্সের’ চূড়ান্ত। ওই ধারার অন্যতম উদাহরণ, ঊনবিংশ শতাব্দির মার্কিন লেখক Frank Stockton এর বিখ্যাত গল্প ঞThe Lady on the Tiger. রাজকন্যার হাতে আছে তার প্রেমিকের ভাগ্য। কোনটা সে বেছে নেবে? প্রিয়তমের নিষ্ঠুর মৃত্যু, না তাকে অন্য নারীর বাহুবন্ধনে তুলে দেওয়া? পাঠকের হাতে মীমাংসার ভার দিয়ে লেখক বিদায় নিয়েছেন। রাজকন্যার পরীক্ষা পাঠকের ও পরীক্ষা।৪
ছোটো বড়ো মিলিয়ে হুমায়ূন আহমদের দেয়াল উপন্যাসে মোট পরিচ্ছেদ সংখ্যা ২৩ টি। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম চরিত্র শফিক। একজন বিনম্র, মেরুদন্ডহীন, রুচিবান, লাজুক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত তরুণ। দ্বিতীয় চরিত্র অবন্তি। বড়োলোকের ঘরের খেয়ালী স্বভাবী এক রহস্যময়ী নারী। শফিকের প্রাইভেট ছাত্রী সে। এরপর পর্যায়ক্রমে আসে অবন্তিদের বাড়ির দারোয়ান কালাম, চায়ের দোকানি কাদের, শফিকের বন্ধুরূপী বন্ধুকুকুর কালাপাহাড়, অবন্তির দাদা সরফরাজ খান, কাজের মেয়ে রহিমা, অবন্তির মা ইসাবেলা, জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং আদর্শলিপি প্রেসমালিক রাধানাথ। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে উপস্থিত প্রেস কর্মচারি ফণি, মেজর শরিফুল হক ডালিম এবং অবন্তির তথাকথিত স্বামী পীর হাফেজ জাহাঙ্গীর। তৃতীয় পরিচ্ছেদে পাওয়া যায় সরফরাজ খানের গ্রাম সোহাগীর বাড়ির কেয়ার টেকার ধীরেন, ধীরেনের স্ত্রী রাধা, মালি দবির, পীর হামিদ কুতুবী, পীর সাহেবের স্ত্রী জুলেখা বেগম, দাসী সালমা এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সামস। চুতুর্থ পরিচ্ছেদে হাজির হন মেজর ফারুক, মেজর ইশতিয়াক, হাটহাজারীর আন্ধা হাফেজ, মেজর রশিদ, খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, RAW এজেন্ট কাও, জেনারেল ওসমানী, জেনারেল জিয়া এবং বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং রাজনৈতিক সহচরবৃন্দ। পঞ্চম পরিচ্ছেদে সরাসরি উপস্থিত হন হুমায়ূন আহমেদ এবং শামীম শিকদার। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে পাওয়া যায় নূরু, মনা বাবুর্চি মুজিব সেন্টারের ছানু মিয়াকে। সপ্তম পরিচ্ছেদে দেখা মেলে জাসদের আব্দুর রব, মাওলানা ভাসানী, শিরাজ শিকদার, আওয়ামীলীগার মোজাম্মেল, ডোরা রাসনা, আবু বক্কর এবং খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। সপ্তম অনুচ্ছেদে যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী নওয়াব, অধ্যাপক জাফর মাহমুদ, আহমদ ছফা, সিকান্দার আবুজাফর, কাদের সিদ্দিকী, শেখ কামাল, তোফায়েল আহমেদ, কাইয়ূম, হুমায়ূনের বন্ধু ইংলিশ ম্যান, মা আয়েশা ফয়েজ এবং বোন শিখু। নবম পরিচ্ছেদে উপস্থিত পাওয়া যায় কর্নেল ফারুকের স্ত্রী ফরিদাকে। দশম অনুচ্ছেদে দেখা মেলে হরিদাস নাপিত, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাজের লোক রমা, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, মোফাজ্জল হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জামিলের। একাদশ অনুচ্ছেদে দেখা মেলে শেখ হাসিনার গৃহশিক্ষক অভিনেতা আবুল খায়ের এবং কবি নির্মলেন্দু গুণের। দ্বাদশ অনুচ্ছেদে যুক্ত হন সংগীত শিল্পী শচীন দেববর্মন, এসপি সালাম, মার্কিন কুটনীতিক বোস্টার প্রমুখ। ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদে যুক্ত হন অবন্তির বাবা এবং ৩রা নভেম্বরের বিভীষিকার বলি জাতীয় চার নেতা। চতুর্দশ পরিচ্ছেদে যুক্ত হন শাফাত জামিল, কর্নেল হুদা এবং আলিম ডাকাত। পঞ্চদশ অধ্যায়ে উপস্থিত হন মাহবুবুল আলম চাষী। ষোড়শ অধ্যায়ে পাওয়া যায় সীপাহী নওজোয়ানবৃন্দ, ক্যাপ্টেন আসাদ, ক্যাপ্টেন জলিল, খালেদ মোশাররফের স্ত্রী সালমা প্রমুখকে। সপ্তদশ অধ্যায়ে যুক্ত হন প্রেস ম্যানেজার শশাঙ্ক এবং রাধানাথের ভাগ্নে পরিমল। অষ্টাদশ অধ্যায়ে যুক্ত হন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত, তাহেরের মা আশরাফুন্নেছা, তাহেরের ছোটো ভাই আনোয়ার হোসেন (পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য), তাহেরের ভাই-বোন এবং পরিবারবর্গ, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। ঊনবিংশতি পরিচ্ছেদে যুক্ত হন কার্তিক স্বর্ণকার। বিংশতি অনুচ্ছেদে পাওয়া যায় সিআইডি ইন্সপেক্টর হাসানুজ্জামান, তাহেরের বোন শেলী, স্ত্রী লুৎফা প্রমুখকে। একবিংশতি অধ্যায়ে পাওয়া যায় সিরাজুল আলমখান এবং সাংবাদিক লিফশুলৎজকে। দ্বাবিংশতিতে যুক্ত হন রোনিও, জেনারেল শিশু, জেনারেল মঞ্জুর। দ্বাত্রিংশতি অধ্যায়ে পাওয়া যায় সৌদি বাদশাহ, বেলজিয়ামের রাজা-রাণী, বিচারপতি এম এ সায়েম, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখকে। এছাড়া কল্পনা-বাস্তব মিলিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাণপর্বের প্রসঙ্গত নানা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সমাহার ঘটিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
দেয়ালের নকশায় বাংলাদেশের জন্মের কুশীলববৃন্দ এবং তাদের পরবর্তী কর্মপন্থার গতি-প্রকৃতি নিয়ে আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট একনজরে দেখে নিতে পারি। ইতিহাসের আস্তরণমাখা এই ঘটনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়, দেয়ালের জমিন সমগ্র বাংলাদেশ। দেয়ালের ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে বাংলাদেশের ইতিহাসের কাল পর্বের নানা ঘটনার অনুপুঙ্খ অ্যানেকডট জেনে রাখলে সুবিধা হবে। যদিও সাহিত্য তত্তে¡র গবেষকবৃন্দ এই ধারণার সাথে ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যে সময়কে দেয়ালের নকশার জন্য নির্বাচন করেছেন, তা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পর্ব। আনিসুজ্জামানও ভূমিকায় লিখেছেন ‘গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই দেয়াল নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্টের পরামর্শ-অনুযায়ী লেখক উপন্যাসটির প্রথম প্রকাশিত রূপের পরিবর্তন সাধন করেছেন। গ্রন্থাকারে সেই পরিবর্তিত রূপই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। তারপরও, আমার মনে হয়, দেয়াল বিতর্কিত থেকে যাবে’। সাহিত্যের কাছে ইতিহাসের দায়মোচন আশা করা করাটা বৃথা। কিন্তু হুমায়ূন ইতিহাসকে সামনে রেখে সে দায় শোধ করার চেষ্টারও ত্রুটি করেন নি। দেয়ালকে বিতর্কমুক্ত রাখার জন্য ইতিহাসের মোহাফেজখানায় না গিয়ে আমরা সাহিত্যের আসরে বসে যেতে পারি। কারণ, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ইতিহাসও বদলায়। সত্য ঘটনার রূপায়ণে আমাদের মন ভরে না। আমরা সব কিছু নিজের মতো করে আশা করি। দেয়াল ইতিহাসের বাস্তব ঘটনার অনুবর্তী টেক্সট নির্ভর হলেও বাস্তব ঘটনার অভিজ্ঞতা এখানে নেই এমন কথা বলা যায় না।
ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশ
এক:
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জারিকৃত “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র” বাংলাদেশের প্রথম অন্তবর্তীকালীন সংবিধানের কাজ করেছে। এই সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার বিধান করা হয়। রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানী কারাগারে আটক থাকায় উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেলেন তাজউদ্দিন আহমদ। এতে ৬ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।
দুই.
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১১ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ” (Provisional Constitutional Order) জারি করেন। এই আদেশটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের কাজ করে এবং এটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার বিধান প্রবর্তন করে।৫ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ১২ জানুয়ারি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশে’’র অধীনে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন।
তিন.
প্রধান বিচারপতি হিসেবে জনাব সায়েমকে শপথ গ্রহণ করানোর সাথে সাথেই শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন। তখন প্রধান বিচারপতি সায়েম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন এবং শপথ গ্রহণ করেন। অতঃপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ পূর্বের মন্ত্রীপরিষদের সকল সদস্য পদত্যাগ করেন। অতঃপর রাষ্ট্রপতি “অস্থায়ী সংবিধান আদেশ” এর ৭নং ধারা বলে শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন এবং শেখ মুজিব ১১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়াতে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সরকারকে নতুন করে আনুষ্ঠানিকতাসহ শপথ নেয়ার কথা। কিন্তু সংবিধানে ধারাবাহিকতা রক্ষা ও অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ৪র্থ তফসিলে বলা হলো যে, প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ববর্তী সরকার তথা পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী সংবিধানের অধীনে স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন। বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। ১৬ মার্চ তারিখে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ২১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ৪ এপ্রিল। জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ্ স্পীকার নির্বাচিত হন। ৮ এপ্রিল তারিখে আবু সাঈদ চৌধুরী সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।৬
চার.
২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তারিখে আবু সাঈদ চৌধুরী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।৭ সংবিধানের ৫৪নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্পীকার জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ্ সাময়িকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি চূড়ান্তভাবে সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।৮
পাঁচ.
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী সংসদে পাশ হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত এক দলীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এই সংশোধনী বলে শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন। বিল পাশ হওয়ার সাথে সাথে তিনি স্পীকারের কাছে নয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। শপথের পর পরই ১৭ সদস্য বিশিষ্ট নতুন পদ্ধতির অধীনে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। উপ-রাষ্ট্রপতি করা হলো সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন এম মনসুর আলী। উল্লেখ্য, ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যেহেতু বিধান করা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। সুতরাং নতুন রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসার কথা। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই ৪র্থ তফসিলে বিশেষ বিধান করে (by operation of law) শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হলেন। আরও উল্লেখ্য, বিল পাশ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের সুযোগ না দিয়েই রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং শেখ মুজিব তৎক্ষণাৎ শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপতি হন।৯ রাষ্ট্রপতি হওয়ার ৬মাস পরই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবকে তাঁর পরিবারবর্গের সাথে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ছয়.
১৫ আগস্টে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর অভ্যূত্থানকারীদের সহায়তায় খন্দকার মোস্তাক আহমদ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেন এবং দেশে সামরিক আইন জারি করলেন। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় তিনি ১৬ সদস্য বিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করলেন জনাব মোহাম্মদ উল্লাহকে। প্রধানমন্ত্রী করা হলো আবু সাঈদ চৌধুরীকে, সামরিক আইন জারি করা হলেও সংবিধান এবং সংসদ বাতিল করা হয়নি।
সাত.
১৫ আগস্টের মুজিব হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল সামরিক বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ যার নেতৃত্ব দিয়েছিল মেজর রশিদ, মেজর ফারুক এবং বরখাস্তকৃত মেজর ডালিমসহ কয়েকজন জুনিয়র অফিসার। অভ্যুত্থানকারী সেনা অংশটি উর্ধ্বতন সামরিক মহলকে অবজ্ঞা করে বঙ্গভবনে অবস্থান করে এবং সেখান থেকে মোস্তাক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে এবং সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ জারি করতে থাকে। সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসারগণ অভ্যুত্থানকারী মেজরদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হন এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদেরকে নিরস্ত্র করার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। তখন সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং উপ-প্রধান ছিলেন খালেদ মোশাররফ। খালেদ মোশাররফই পাল্টা অভ্যুত্থান নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে মূলত দু’টি অভ্যূত্থান ঘটে। একটি ঘটে অভ্যূত্থানকারী অফিসার এবং খালেদ মোশাররফের মধ্যে এবং অন্যটি ঘটে খালেদ মোশাররফ এবং নওজোয়ান ও সিপাহীদের মধ্যে। প্রথম অভ্যূত্থানটি ঘটে ৩ নভেম্বর। এ দিন ভোরে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি মোস্তাকসহ বঙ্গভবন অবরোধ করে ফেলেন; বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র অবরোধ করেন; সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন এবং বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ফারুক-ডালিম গ্রুপটিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এ চক্রটি আত্মসমর্পণে অস্বীকার করে। তখন মোস্তাক সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ওসমানীর হস্তক্ষেপে দুই গ্রুপের মাঝে সমঝোতার প্রেক্ষিতে ফারুক-ডালিম গ্রুপের ১৫জন অফিসার ও ২জন এনসিও তাদের পরিবারসহ দেশত্যাগে রাজী হন। এ অবস্থায় মোস্তাক বুঝতে পারেন যে, তাঁর ক্ষমতাচ্যুতি অনিবার্য। তখন তাঁরই গোপন নির্দেশে এবং পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩রা নভেম্বর দিনগত রাত অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ভোর ৪টায় দেশত্যাগী সৈন্যরা কারাগারে বন্দী চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্য করে; যাতে করে মুজিবের প্রকৃত অনুসারীরা আর ক্ষমতায় বসতে না পারে।১0 ইতিমধ্যে খালেদ মোশাররফ জিয়াকে সামরিক বাহিনীর প্রধান থেকে চাপের মুখে পদত্যাগ করান এবং নিজে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে ৪ঠা নভেম্বর মেজর জেনারেলে উন্নীত হয়ে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে বসেন। অতঃপর খালেদ মোশাররফ গ্রুপটি রাষ্ট্রপতি মোশতাককে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করে এবং ৫ নভেম্বর দিনগত রাত ১টায় অর্থাৎ ৬ নভেম্বর ভোরে প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।১১ দ্বিতীয় অভ্যূত্থানটি ঘটে ৭ নভেম্বর। ৪ নভেম্বরে আওয়ামী লীগের শোক মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাইয়ের অংশগ্রহণ, ৩, ৪ ও ৫ নভেম্বর-এই তিন দিনে খালেদ মোশাররফের সিদ্ধান্তহীনতা বা কোনো ঘোষণা না দেয়ায় জনগণের মাঝে অস্থিরতা, জেনারেল জিয়াকে অপসারণ, মোস্তাক ও ওসমানীর পদত্যাগ, ১৫ আগস্টের অভ্যূত্থানকারীদের দেশত্যাগের ফলে জনগণ ও ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিকদের মাঝে আতংক, মুসলীম লীগ ও জাসদ কর্তৃক খালেদ মোশাররফকে ভারতের দালাল ও দেশদ্রোহী চিহ্নিত করে লিফলেট ছড়ানো এবং সর্বোপরি কর্নেল তাহের কর্তৃক সৈন্যদের বারো দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সিপাহী বিদ্রোহের ডাক-এ সকল কারণে ৭ নভেম্বর মধ্যরাতে সৈন্যরা অস্ত্রাগার ভেংগে গোলাবারুদসহ খালেদ মোশাররফ-বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহে খালেদ মোশাররফসহ বহু অফিসার নিহত হন এবং বিদ্রোহী সিপাহীদের একাংশ গৃহবন্দী জিয়াকে মুক্ত করে। সকালে জিয়ার রেকর্ডকৃত বেতার ভাষণ শুনে জনতা উল্লাসে মেতে উঠে। এভাবে জিয়া আবার সামরিক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। ৮ নভেম্বর Martial Law Proclamation-এর মাধ্যমে জিয়াকে সামরিক বাহিনীর প্রধান করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, বিচারপতি সায়েমই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ৬ নভেম্বর সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পর ৮ই নভেম্বর তিনি দ্বিতীয় সামরিক ফরমান ফরমান The second Martial Law Proclamation জারি করেন। এই ফরমানের মাধ্যমে তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন; সংবিধানের ৪৮নং অনুচ্ছেদসহ ‘৬ষ্ঠ-ক’ ভাগ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন; অধ্যাদেশ প্রণয়নের শর্তহীন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং উপ-রাষ্ট্রপতিসহ মন্ত্রীপরিষদ বাতিল করলেন। ২৬ নভেম্বরে তিনি কিছু সামরিক অফিসার ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, ড. মো. ইব্রাহীম, কাজী আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক আবুল ফজল, ড. আব্দুর রশিদ, ড. এম এন হুদা প্রমুখ। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাইয়ে তিনি রাজনৈতিক দলবিধি জারি করেন এবং ইহার মাধ্যমে কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে জনগণকে রাজনৈতিক দলগঠনের অধিকার দেয়া হয়। আগষ্ট মাস থেকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি সামরিক ফরমান (3rd Martial Law Proclamation) জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে এবং নিজে শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে থেকে গেলেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন এবং জিয়াউর রহমান একই সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে অবতীর্ণ হলেন। উল্লেখ্য, যদিও সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন কিন্তু তাঁর শাসনের সকল চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ করেছেন জেনারেল জিয়া। সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কঠোরভাবে দমন ও অপসারণের পর নিজের ক্ষমতা সুসংহত করে জিয়া প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীতে সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি হলেন।
আট.
জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে তার ক্ষমতার বেসামরিকিকরণ শুরু করেন। উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমেই তিনি দেশ চালাতে থাকেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে গণভোটের মাধ্যমে তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করলেন। ৩ জুন তিনি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করলেন। পূর্বের উপদেষ্টা পরিষদ সময়ে সময়ে রদবদল করে বহাল রাখেন। ১৯৭৮ সালের ১২ জুনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্ন্বীতা করে জিয়া বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হলেন। ২৯শে জুন তিনি উপদেষ্টা পরিষদ বাদ দিয়ে ২৮ সদস্যের নয়া মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলেন। মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলেও এখানে কাউকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। সিনিয়র মন্ত্রী ছিলেন মশিউর রহমান। এরপর ১৯৭৯ সালেই ১৮ই ফেব্রæয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়া হলো। এই নির্বাচিত সংসদ অধিবেশনে বসার পূর্বেই ১৫ মার্চ তারিখে পূনরুজ্জীবিত সংবিধানের সংশোধিত বিধান অনুযায়ী জিয়া ৪২ সদস্য বিশিষ্ট নতুন মন্ত্রপরিষদ গঠন করলেন। প্রধানমন্ত্রী করা হলো শাহ আজিজুর রহমানকে; ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মওদুদ আহমদ হলেন উপ-প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ২ এপ্রিল ১৯৭৯। এই অধিবেশনে ৫ম সংশোধনী পাশের মাধ্যমে সকল সামরিক কর্মকান্ডকে বৈধ করা হয় এবং ৩ বছর ৭ মাস ২১ দিন পরে ৬ এপ্রিল তারিখে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোর রাতে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রামে আর এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থানে নিহত হন।
হুমাযূন আহমেদের দেয়াল ঐতিহাসিক উপন্যাস কি না, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য অবশ্যই নিউ হিস্টরিসিজম এর কথা মাথায় রাখা দরকার। নিউ হিস্টরিসিজম কথাটির প্রচলন পূর্বে ছিল না। ১৯৮০ সালে জঁর পত্রিকা রেনেসন্সের সাহিত্য বিষয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ভূমিকায় স্টিফেন গ্রিনব্যাবাট জানান সংকলনটির প্রবন্ধগুলি এক নিউ হিস্টরিসিজম সূচিত করেছে, সেই থেকে নামটির চল হয়। গ্রিনবø্যাট ছাড়াও সংখ্যাটির বেশ কয়েক জন লেখক ছিলেন মার্কিন। ১৯৮০ সালে আমেরিকার বার্কলিতে পড়তে আসা মিশেল ফুকোর প্রভাব প্রবন্ধকারদের অনেকের উপর স্পষ্ট। ১৯৬৮ সালের প্যারিস অভ্যুত্থানের বিপর্যয়ের পর অনেক ফরাসি বুদ্ধিজীবির মতোই ফুকো বুঝেছিলেন যে ক্ষমতা ভাবাদর্শে ও ভাষায় অন্তর্ব্যাপ্ত, তা বয়ান বা ডিসকোর্সের বাইরের কোনো বস্তু নয়। রোঁল বার্থ যেমন বলেছিলেন ভাষা মানেই বিধান, ভাষা মাত্রেই শাসন। ভাষা, সংস্কৃতি ও ক্ষমতায় এই নিগূঢ় ঐক্যের ধারণার মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা পেয়েছিলেন সাহিত্যের বহু মার্কিন ছাত্র। কোনো ঐতিহাসিক কালপর্বের সংহতির চাইতে তার অন্তর্দ্বন্দ ফুকোর লেখায় প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এছাড়া ফুকোপন্থীরা জোর দেন প্রতিবাদী সম্ভাবনা কীভাবে ডিসকোর্সের শাসনে নিয়ন্ত্রিত বা আত্মসাৎ হয় তার উপর। এই বিচারের সত্য তথা ইতিহাস হলো ক্ষমতা ও অধিষ্ঠিত জ্ঞানের সমবায়ের একটি প্রতিক্ষেপণ এবং টেক্সটের মধ্যস্থতা বিনা এই সত্য ও ইতিহাস অধিগম্য নয়। ইতিহাস কেবলমাত্র টেক্সট, বাস্তব অভিজ্ঞতা নয় এমন চরম কথা নব্য ঐতিহাসিকবাদীরা বলেন না। কিন্তু আমাদের ধরাছোঁয়ার নাগালে সে ইতিহাস তার পাঠ-চরিত্র সম্পর্কে তাঁরা সতর্ক। পক্ষান্তরে টেক্সটকে তারা দেখেন একটি বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে। সাহিত্যের ঐতিহাসিক আলোচনার সাবেক রীতিতে যেমন পুরোভূমিতে পাঠ্যবস্তু ও পটভূমিতে ইতিহাস অথবা যুগমানসকে কল্পনা করা হতো, তেমন প্রকল্প এই নব্য বিচার পরিহার করে। সাহিত্যের টেক্সটের সঙ্গে অন্য গোত্রের পাঠ্যবস্তু যেহেতু এ ব্যাপারে অভিন্ন, তাই নব্য ঐতিহাসিকতাবাদী আলোচনায় এই দুই ধরনের টেক্সটকে প্রায়শই একত্রে অথবা পাশাপাশি পড়া হয়ে থাকে। উভয় জাতের টেক্সটেই শাসন-অন্তর্ঘাত নিয়ন্ত্রণের বৃত্তটির ক্রিয়া বিদ্যমান, কারণ উভয়ই একটি সংস্কৃতির ব্যাপকতর প্রতীক ব্যবস্থার শরিক। এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক নৃতত্তে¡র প্রতীক-বিশ্লেষণ প্রণালি প্রয়োগ করেছেন গ্রিনবø্যাট ও তার অনুগামীরা। গ্রিনবø্যাট এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন সংস্কৃতির বাক্যতত্ত¡। অবশ্য নিউ হিস্টরিসিস্টদের সহযাত্রী, রেমন্ড উইলিয়মসের অনুগামী ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক বস্তুবাদীরাও গ্রিনবø্যাট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নানা আপত্তি তুলেছেন। তাঁদের আশংকা যে মার্কিন বিনির্মাণবাদীদের মতো গ্রিনবø্যাট শিবির ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দায় থেকে পিছু হটছেন। তার বদলে গুরুত্ব পাচ্ছে প্রায় স্বশাসিত একটি সংস্কৃতির বা প্রতীক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ। এই বিশ্লেষণেও বেশি জায়গা জুড়ে আছে রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিরূপায়নের বিচার।।১২
পাঠ্যবস্তুকে বিশেষ করে মহাফেজখানার সরকারি বৃত্তান্তের বাইরে অবস্থিত সাহিত্যকে সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ এক নিরন্তর সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। ডিসকোর্স এই সংঘর্ষের মাধ্যমে বদলায় এবং পাঠ্যবস্তুর ব্যাখ্যারও তাই নিষ্পত্তি হয় না। শাসন-বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণের প্রায় ছেদহীন বৃত্তে লেখকের প্রতিরোধী ভূমিকার পরিসর কম। অতীতের পাঠ্যবস্তু বর্তমানে যে রাজনৈতিক ভাবাদর্শগত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে তাকে প্রশ্ন করাও জনাথন ডলিমোর, অ্যালান সিনফিল্ড প্রমুখ সাংস্কৃতিক বস্তুবাদীরা তাঁদের সামাজিক দায় বলে মনে করেন। অন্যদিকে পেশাদার ইতিহাসবিদরা বলেন যে নব্য ঐতিহাসিকতাবাদীরা প্রায়শই সাক্ষ্যবিচারে পক্ষপাত দেখান, টুকরো বৃত্তান্ত বা অ্যানেকডোটের উপর নির্ভর করেন বেশি, ঘটনার অনুপুঙ্খ ধার করেন পুরোনো ঐতিহাসিকদের সেকেলে গবেষণা থেকে।১৩
হুমায়ূন আহমেদ দেয়ালের পরিমার্জিত সপ্তম সংস্করণের শেষে বাংলাদেশ ও মুক্তযুদ্ধকেন্দ্রিক নানাবিধ ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ ৩০টি বইয়ের তালিকা দিয়েছেন। যে সকল বইয়ের রেফারেন্স তার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে, সে সকল রেফারেন্স তিনি উল্লেখ করেছেন পাদটীকায়। কিন্তু দেয়াল উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় তিনি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েই আখ্যান নির্মাণে অগ্রসর হন। দেয়ালে বিভিন্ন গ্রন্থের উল্লেখ থাকলেও একমাত্র Anthony Mascarenhas : Bangladesh: A Legacy of Blood গ্রন্থখানির প্রভাব বইটির সর্বত্র। আদালত দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পর থেকে তিনি ঘটনার সাথে সামঞ্জস্য আছে এমন তথ্যসমৃদ্ধ বইয়ের খোঁজ করেন। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আন্ধা হাফিজ, কর্নেল ফারুকের স্ত্রী ফরিদা, স্ত্রীর বোন অর্থাৎ কর্নেল রশিদের স্ত্রী, বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা, ১৫ আগস্টের ঘটনা, ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপঞ্জি, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, জিয়া হত্যার কারণ প্রভৃতি ঘটনার বর্ণনায় তিনি সরাসরি Anthony Mascarenhas : Bangladesh: A Legacy of Blood গ্রন্থখানি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এবং জিয়ার চরিত্রের বর্ণনা হুবহু অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এর লেখার সাথে মিলে যায়। এই ঘটনা সম্পর্কে Anthony Mascarenhas : Bangladesh: A Legacy of Blood এর আগে আর কোনো লেখায় বিস্তারিত একসাথে পাওয়া যায় বলে বর্তমান প্রবন্ধকার মনে করেন না। দেয়াল উপন্যাসের পেছনের ফ্ল্যাপের যে রং ব্যবহার করা হয়েছে তা রক্তাক্ত বাংলাদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও, হাক্কানি পাবলিশার্স থেকে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস রচিত বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ গ্রন্থের প্রথম প্রকাশের প্রচ্ছদের রংটির কথা মনে করিয়ে দেয়। হুমায়ূন আহমেদ পুরো উপন্যাসেই মাসকারেনহাস এর বইয়ের বয়ান করেছেন মাত্র। মাসকারেনহাস এর লেখায় জিয়াউর রহমানের প্রতি একধরনের সহানুভূতির যে প্রকাশ, হুমায়ূন আহমেদ এর নির্মিত জিয়া তারই অনুকৃতি। এখানে হুমায়ূন কোনো নতুনত্ব নিয়ে আসতে পারেন নি। কখনো মনে হয়েছে দেয়াল না হয়েছে উপন্যাস, না হয়েছে প্রবন্ধ। তাছাড়া গ্রন্থপঞ্জিতে যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে, তার কোনোটিরই প্রকাশের স্থান এবং সময় উল্লেখ করা হয়নি। কখনো মনে হয়েছে তিনি বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থের ডিকটেশন নিয়েছেন মাত্র, কিন্তু তার পরিমাণ খুবই নগণ্য। দেয়ালে Anthony Mascarenhas : Bangladesh: A Legacy of Blood বাংলা সংস্করণ বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ গ্রন্থের বর্ণনাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা তথ্যের সাথে মিলিয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন।
আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ‘চরিত্রের খেয়ালিপনা, সংলাপের সংঘাত, ঘটনার আকস্মিকতা ও কার্যকারণহীনতা আমাদেরকে সবসময়ে রহস্যময়তার দিকে আকর্ষণ করে’।১৪ হুমায়ূন আহমদের পাঠকপ্রিয় অন্যান্য উপন্যাসসমূহের মতোই দেয়ালকে নিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেই হারিয়ে ফেলেছেন। হুমায়ূনের প্রকাশভঙ্গির যে চমক লাগানো জাদু, তা এখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তার অবস্থা হয়েছে সেই শল্য চিকিৎসকের মতো, ‘যিনি চিকিৎসা বিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা না করেও হাতযশে আর মধুর ব্যবহারেই রোগীদের মন জয় করেন (ভারতীয় চলচ্চিত্র আধুনিক মুন্না ভাই এমবিবিএস এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে)। তার চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়। তিনি অনায়াসে সব ধরনের অস্ত্রোপচার করেন। তার অপরিসীম জনপ্রিয়তা। অনেক উচ্চতর ডিগ্রিধারী ডাক্তারও তার সমান পসার জমাতে পারেন না। স্বাস্থ্য বিভাগের একজন উর্ধ্বতনের সাথে আলাপের পরে সেই ডাক্তার একদিন মনস্থ করলেন, তিনি এবার প্রাতিষ্ঠানিক শল্য চিকিৎসার উপর একটা প্রশিক্ষণ নেবেন। তার প্রশিক্ষণ শেষও হলো। এবার তিনি অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে ভীষণ ভয় পেলেন। পূর্বে কোনো কিছু চিন্তা না করেই তিনি অনায়াসে কাজ করতেন, কিন্তু এখন নার্ভ এবং ভেন সম্পকে অতিরিক্ত সতর্কতা কাজ করায় তার হাত আর চলে না। তিনি ভয় পান অপারেশনে। তার পসার বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তার সত্তারও মৃত্যু হলো’।
একুশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝিতে এসে হুমায়ূন তথ্যসমৃদ্ধ লেখার মাধ্যমে সিরিয়াস পাঠকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। ভাষার প্রকাশগুণে তিনি সফলও হন। কিন্তু শেষ উপন্যাস দেয়ালে এসে হুমায়ূনের শারিরীক মৃত্যুই শুধু নয়, লেখকসত্তারও মৃত্যু হলো। কিন্তু পাঠকেরা হুমায়ূনকে ত্যাগ করেন নি। ম্যাজিশিয়ান বিষয় নির্বাচনে ভুল করেন নি, বিষয়গুণেই পাঠক জলের বেগে ধাবিত হয়েছে দেয়ালের দিকে। তাছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতহাসের বিয়োগান্ত ঘটনার পাশাপাশি ফ্রয়েডের মনস্তত্ত¡, সিজোফ্রেনিয়া, রোমান্টিসিজম, সেক্স প্রভৃতি প্রসঙ্গের হালকা রসের ফ্লেভার সমৃদ্ধ ককটেল পরিবেশন করার কারণেও দেয়াল পাঠকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেছে।
মার্কস সাহিত্য তত্ত¡ সম্পর্কে কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। তার যা কিছু সাহিত্য তত্ত¡ সম্পর্কিত রচনা, সবই চিঠি-পত্রে। মার্কসীয় সাহিত্যতত্তে¡র প্রধান বিষয় হচ্ছে সাহিত্যের সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্ক কী, বাস্তব কীভাবে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ কীভাবে বিষয়কে রঞ্জিত করে, এই তিনটি। … বাস্তব কীভাবে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, মার্কসের সেই মতামত বিশদ করেন গিয়র্গি লুকাচ (১৮৮৫-১৯৭১)। সমাজের যেসব ঘটনা, চরিত্র, আবেগ প্রতিনিধি স্থানীয়, সেসবই সাহিত্যে আসে, যেসব ব্যতিক্রমী সেগুলো অবান্তর। কিছু চিঠিতে লাসাল-এর নাটক সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস এমন মত প্রকাশ করেছিলেন। বাস্তব শুধু অনুপুঙ্খ সত্য হলেই চলবে না, তার যথার্থ প্রতিফলন তো প্রয়োজনীয়ই, কিন্তু তার থেকে বড়ো কথা, সেসব সমাজের শ্রেণিবিন্যাসকে প্রতিনিধিমূলক চরিত্রের মধ্যে ফুটে উঠেছে কিনা, সেটাই বড়ো কথা।১৫ সাহিত্য যে শুধু বাস্তবের বা সমাজের অর্থনীতির প্রতিফলন নয়, সে কথা মার্কস-এঙ্গেলস বার বার বলেছেন। সাহিত্যের নিজের একটা বিশ্ব আছে, তার উপাদান ভাষার একটা নিজস্ব গতি আছে, মানুষের মন কীভাবে কাজ করে, এই সব বিষয়ে মার্কস যেসব ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী মার্কসিস্টরা বিভিন্ন তত্ত¡ তৈরি করেছিলেন। আমরা লক্ষ করি হুমায়ূন আহমেদ কিছু প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থাৎ ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত কালরেখাকে দেয়াল উপন্যাসের প্রেক্ষাপট করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ তার দেয়াল উপন্যাসের ২৩টি পরিচ্ছেদে সমগ্র বাংলাদেশকে পশ্চাদভূমি করে, বাস্তব-কল্পনায় মিলিয়ে ৯০টির মতো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক চরিত্র সরাসরি ইতিহসের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিছুসংখ্যক চরিত্র কাহিনীর পরিধিকে গতি দিয়েছে মাত্র। পাশাপাশি স্বভাবসুলভ সংলাপের আশ্রয়ে হুমায়ূন আহমেদ দেয়াল নির্মাণ করেছেন। এখানে তার নিজস্বতার ছাপও রয়েছে। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম চরিত্র শফিক। একজন বিনম্র, মেরুদন্ডহীন, রুচিবান, পড়ুয়া, লাজুক, বুদ্ধিমান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত তরুণ রফিকের মাঝে হুমায়ূনের নিজস্ব চরিত্রের ছায়া দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে এই শফিক সাহসী হয়ে উঠে।
“পনেরই আগস্ট রাত ন’টার দিকে সরফরাজ খানের বাড়ির সামনের রাস্তায় এক যুবককে চিৎকার করতে করতে সড়কের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত যেতে দেখা গেল। সে চিৎকার করে বলছিল ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’। যুবকের পেছনে যাচ্ছিল ভয়ঙ্করদর্শন একটি কালো কুকুর। সেই রাতে অনেকেই রাস্তার দুপাশের ঘরবাড়ির জানালা খুলে যুবককে আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধও করে ফেলছিল”।১৬ আদর্শলিপি প্রেসের মালিক রাধানাথ যখন শফিককে জিজ্ঞাসা করলেন যে তার সাহস আছে কী না রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলার যে সে মুজিব হত্যার বিচার চায়। তখন শফিককে বলতে শোনা যায় যে তার সাহস নেই। সে খুবই ভীতু মানুষ। কিন্তু সে বলবে। আসলে শফিকের মধ্যে একটি জ্বলন্ত আগুন ছিল। কিন্তু সে আগুন ছিল ভীরুতা আর আড়ষ্টতায় আচ্ছন্ন। শফিক হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠেনি। সাহস তার ভেতরে ছিল। কিন্তু সাহস দেখানোর জন্য সে অবন্তিদের বাড়ির সামনের রাস্তাটিকেই বেছে নিল, এর পেছনের কারণ অবশ্যই উদঘাটন করা প্রয়োজন। মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে (বিশেষ করে কোনো মেয়েকে) তখন তার সামনে সাহসী হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। তবে কি শফিক অবন্তিকে ভালোবাসতো? কিন্তু দেয়ালের কোথাও তাদের মধ্যে এমন সম্পর্কের প্রকাশ ঘটেনি। তবে অবন্তি নিজেকে যখন খুব নিরাপত্তাহীন এবং নিঃসঙ্গ ভেবেছে, তখন সে শফিককে পাশে চেয়েছে। দেয়াল উপন্যাসে শফিকের সাথে হুমায়ূন আহমদের দেখা হয় অষ্টাদশ অধ্যায়ে। হুমায়ূনের নীলহাতি বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী শফিক। পরিবারবর্গসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতীয় চার নেতা, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশররফও হত্যার শিকার হলেন। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট পরবর্তী ঘটনার এক পর্যায়ে অবন্তির দাদা সরফরাজ খানও হঠাৎ নিখোঁজ হলেন। তখন অবন্তি নিরুপায় হয়ে শফিককে তাদের বাসায় থাকতে বলেছিল। এর পেছনে অবন্তির শফিকের প্রতি ভালোবাসা, নাকি নিরাপত্তাবোধ কাজ করেছিল তা হুমায়ূন আহমেদ পরিষ্কার করে বলেন নি। বলার প্রয়োজনও ছিল না। এরকম ধাঁধাঁ সৃষ্টি করাই হুমায়ূনের কারিশমা। লেখক যদি সব কথা অকপটে বলেই দেন, তবে পাঠকের ভাবনার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অবন্তি হুমায়ূন আহমদের অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র। কিন্তু দেয়ালের পরিসরে তিনি অবন্তিকে বিকাশ ঘটাতে পারেন নি। দেয়ালকে ঘিরে আবর্তিত ঘটনার প্রবাহ এবং চরিত্রসমূহ নিয়েও তিনি একাধিক উপন্যাস রচনা করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু যে মলাটের মধ্যে তিনি পুরো কাহিনীটি তুলে ধরেছেন, তা খুবই আটোসাঁটো হয়েছে। হয়তো আটোসাঁটো হয়েছিল বলেই তিনি দেয়াল পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন। নয়তো পাঠকের হাতে দেয়াল পৌঁছানোর আগেই তাকে হারানোর কষ্ট সবাইকে সহ্য করতে হতো।
অবন্তি এবং শফিকের মধ্যে একটি দেয়াল ছিল। যে দেয়ালের কারণে তাদের দুজনকে পাঠক যেভাবে দেখতে চায়, সেভাবে দেখতে পারেনি। অবন্তি ছিল হাফেজ জাহাঙ্গীরের বাগদত্তা। অবন্তির দাদা ৭১-এ পাকসেনাদের হাত থেকে প্রিয় নাতনীকে রক্ষার জন্য তরাই নদী পেরিয়ে সোহাগী গ্রামের নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তখন তিনি নিজের বাড়িতেও নিরাপত্তার অভাবের কারণে নাতনীকে রাখলেন আপন পীর হামিদ কুতুবী সাহেবের হুজরাখানায়। পরবর্তীতে অনিচ্ছা স্বত্তে¡ও হামিদ কুতুবির বাড়ি হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। সেখানে অবন্তির নাম রাখা হলো মায়মুনা। নিরাপদেই ছিল অবন্তি। হঠাৎ একদিন ক্যাপ্টেন সামসের নজরে পরে গেল সে। পীর হামিদ কুতুবী তখন অবন্তির নিরাপত্তার কথা ভেবে নিজ পুত্র হাফেজ জাহাঙ্গীরের সাথে বিশেষ কৌশলে রেহেলের গায়ে হাত ছুঁইয়ে বিয়ে পরিয়ে দিলেন। অবন্তি জাহাঙ্গীরকে কোনো দিনই স্বামী হিসেবে মেনে নেয়নি। জাহাঙ্গীরও কোনো দিন স্বামীর অধিকার দাবি করেনি। তাদের মধ্যে পত্র বিনিময় হতো এবং ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে অবন্তির যাওয়া আসাও ছিল। জাহাঙ্গীরকে অত্যন্ত বিনয়ী, চুপচাপ, চতুর এবং সহনশীল চরিত্র হিসেবেই দেয়ালে উপস্থাপন করা হয়েছে। অবন্তির চোখ দুটি ছিল অসাধারণ সুন্দর। অবন্তির সাথে সাক্ষাতের একুশ বছর পর হুমায়ূন লীলাবতী উপন্যাস রচনা করেছিলেন। লীলাবতীর রূপ বর্ণনায় তিনি অবন্তিকে সামনে রেখেছিলেন।
দেয়াল উপন্যাসের শুরুতে আমরা লক্ষ করি স্বাধীনতা পরবর্তী কালের বাংলাদেশের আার্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত। Lawrence Ziring তার Bangladesh: From Mujib to Ershad গ্রন্থে লিখেছেন ‘Mujib was a fine Bangabandhu but a poor prime-minister’.১৭ বাংলাদেশের প্রথম পর্বে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়: সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হলো না। বাংলাদেশে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথে সর্বশেষ চরম আঘাতটি ছিল চতুর্থ সংশোধনীর দ্বারা সৃষ্ট একদলীয় শাসন কায়েম। দেশে তখন বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে শুরু করেছে; আওয়ামীলীগ বিভক্ত হযে গেছে; ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে গেছে-এ অবস্থায় একদলীয় শাসনের প্রবর্তন করা হলো। কিন্তু সে শাসনের মাধ্যমে দেশের বিরাজমান অর্থিৈতক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে হবে তার কোনো দিক-নির্দেশনা বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সংশোধনী ভাষণে ছিল না। ‘ক্যাবিনেটেও তিনি নতুন কাউকে ঢোকালেন না; কাউকে বাদ দিলেন না; রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের বিষয়েও কিছু বললেন না’।১৮ এতবড়ো একটা পরিবর্তন তিনি করলেন কিন্তু কারোর সাথে পরামর্শ করলেন না; জনমতের তোয়াক্কা করলেন না; দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের পরামর্শ না নিয়ে বরং তাদেরকে একনায়কসুলভ আচরণে শাসিয়ে দিলেন। ‘পুরো রাজনৈতিক কাঠামোকে এভাবে পরিবর্তন করার পেছনে মুজিবের দুর্বলতাই লুকিয়ে ছিল।১৯ তিনি জনগণের ইচ্ছাকে নিজের ইচ্ছা বলে ধরে নিতেন। এটা ছিল তার চরম ভুল। একদলীয় শাসন এবং একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি প্রবর্তনে সাংবিধানিক সরকার বিকাশের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হলো। কারণ যেখানে বাক-স্বাধীনতা থাকলো না; প্রেসের স্বাধীনতা থাকলো না; সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার পথ থাকলো না; বিরোধীদল গঠনের অধিকার থাকলো না-সেখানে কোনোভাবেই সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্টিত হতে পারে না।২0
আমাদের সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির সঙ্গে উপনিবেশবাদের চলমান ইতিহাসের বিভিন্ন স্তর, ফলাফল, পরিবর্তন, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি জড়িত। বিভিন্ন গবেষক, চিন্তাবিদের কাজ নিঃশর্তভাবে গ্রহণ বা বর্জন না করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ধ্রুব সত্যের সন্ধান না করে উঠে আসা প্রশ্নগুলোকে খতিয়ে দেখতে ক্ষতি নেই। যারা পোস্টকলোনিয়াল তত্ত¡ নিয়ে প্রশ্ন থাকা সত্তে¡ও কাজ করতে রাজি, তারাও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন একথা সত্যি যে উপনিবেশবাদ পুরোপুরি মৃত নয়। তার নিজের শুরু করা প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সে বেঁচে রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়ার বর্তমান রূপকে কি তুলে নিয়ে তার ইতিহাসের আগের অধ্যায়ে মাপ মতো বসিয়ে দেওয়া যায়? নাকি এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেছে যা আর আগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরিভাবে কার্যকর প্রয়োজন। আজকের সমাজে সামাজিক-রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার গোটাটাকেই কি নয়া উপনিবেশবাদ, উপনিবেশবাদ-বিরোধী বা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ইত্যাদি মোড়কে কার্যকরভাবে চিহ্নিত করা যায়? না কি উপনিবেশবাদের শিকড় আমাদের সমাজ জমিতেও এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে আমাদেরই মানবজমিনে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে তার ফল হয়ে উঠেছে আরও জটিল ও মিশ্রিত (রঙ্গন চক্রবর্তী: ১৮৫)। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সে কথাই বলে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ নং অনুচ্ছেদের সংযোজনের পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলত্যাগ ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপূরক একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কাজেই দলত্যাগ প্রতিরোধ করার জন্য আইন তৈরি করা হলে উক্ত আইন গণতন্ত্রের চর্চার জন্য প্রতিবন্ধক হতে বাধ্য। কিন্তু, বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজনীতিতে তিক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে দলত্যাগ বিরোধী আইন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানেই ৭০ অনুচ্ছেদ দলত্যাগ বিরোধী বিধান সন্নিবেশ করা হয়। ভারতে ১৯৮৫ সালে ৫২তম সংশোধনীর মাধ্যমে দলত্যাগ বিরোধী বিধান সংযোজন করা হয়। দলত্যাগের ফলে সরকার কখনো স্থিতিশলি হতে পারে না। ফলে দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভবপর হয় না। দলত্যাগের দ্বারা নির্বাচনী দলের সাথে প্রতারণা করা হয় এবং উক্ত দলকে সরকার পরিচালনায় বিপদে ফেলা হয়। ফলে দলীয় রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা ঘটে। দলত্যাগ নৈতিকতা ও রাজিৈতক মুল্যবোধের গভীর সংকটের সৃষ্টি করে; এটি ব্যাপকভাবে দুর্নীতির জন্ম দেয়। দলত্যাগী গোষ্ঠী (Splinter group) নতুন নতুন দলের জন্ম দেয় এবং ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। আবার ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অন্যান্য দলকে নিজ দলে আনার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে রাজনীতি সাধারণত আদর্শভিত্তিক নয়; বরং সুবিধাভিত্তিক। এখানকার অধিকাংশ দলগুলোই ষড়যন্ত্র, ব্যক্তিস্বার্থ এবং ক্ষমতালোভের নীতি দ্বারা পরিচালিত এবং প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতারই একনায়কসুলভ মনোভাব থাকে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সফলতা যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর ফলপ্রসু কার্যকারিতার উপর নির্ভরশীল; আমাদের দেশের রাজনীতি যেহেতু সুবিধাভিত্তিক সুতরাং সংসদ সদস্যগণ দলত্যাগ ও ফ্লোরক্রসিং এর মাধ্যমে ঘন ঘন সরকারের ভরাডুবি ঘটিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অকার্যকর করতে পারে। এ কারণে সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য ৭০ নং অনুচ্ছেদের বিধান যৌক্তিক ও অপরিহার্য, যদিও গণতান্ত্রিক নয়। এ বিধানের ফলে বাংলাদেশে সরকারের যখন তখন পতনের সম্ভাবনা নেই; সরকার স্থিতিশীল হয়ে কাজ করার সুযোগ পাবে। সুতরাং ৭০নং অনুচ্ছেদকে সম্পূর্ণভাবে উঠিয়ে দিলেও বিপদ আছে। তাই আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে একটি আপোষমূলক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একদিকে দলত্যাগ ও বন্ধ করা যাবে, সংসদীয় সরকারের জবাবদিহিতা ও অক্ষুণ্য রাখা যাবে। ৭০ নং অনুচ্ছেদের বর্তমান চলমান বিধান কোনো মতেই পরিপূর্ণরূপে গ্রহণযোগ্য নহে, ইহা সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বংসের জন্য উপযুক্ত মাত্র।২১
বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহই স্মরণ করিয়ে দেয় ৭৫ পরবর্তী শাসকদের হাতে পরে সংবিধান এবং দেশের জনগণের কী হাল হয়েছে। সবাই বঙ্গবন্ধু নন। কাজেই বঙ্গন্ধুকে যে অধিকার এদেশের জনগণ দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালের সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ যদি তাদের উপরই প্রয়োগ করেন, তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই শুধু নয় অভিশাপও বটে। দেয়ালকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ইতিহাসের এই কালপর্ব নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী গবেষণা হতে পারে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যসহ অন্যান্যদের হতার বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে, জাতীয় চার নেতার বিচারের রায় ঘোষণা হয়েছে, মঞ্জুর হত্যা মামলা সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনেক অজানা অধ্যায়ের মীমাংসা হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ দেয়াল উপন্যাসের মাধ্যমে তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র। তিনি যে ক্যানভাস নিয়েছিলেন তার সাথে দেয়ালের কাঠামো মোটেই মানানসই হয়নি। ভাগ্যিস তিনি শেষ করেছিলেন, নয়তো দেয়ালকে অসমাপ্ত রেখেই তাকে ক্যান্সারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হতো। পাঠকের এই অতৃপ্তিটুকু তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন, এটুকুই বড়ো প্রাপ্তি।
Reference:
- সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, ধ্রæবপদ বুদ্ধিজীবীর নোট বই সুধীর, চক্রবর্তী সম্পা. (কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ২০০০), পৃ. ৩০৭।
- হুমায়ূন আহমেদ, মধ্যাহ্ন (ঢাকা: অন্যপ্রকাশ, ২০০৭), ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।
- হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু পরবর্তী প্রথম স্মরণসভা উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমিতে প্রদত্ত ভাষণ।
- সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, ধ্রুবপদ বুদ্ধিজীবীর নোট বই সুধীর, চক্রবর্তী সম্পা. (কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ২০০০), পৃ. ৩০২ ও ৩০৭।
- ব্যারিস্টার এম এ হালিম, সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ (ঢাকা: সিসিবি ফাউন্ডেশন, ২০১১), পৃ. ৩৪-৩৫।
- ব্যারিস্টার এম এ হালিম, সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, পৃ. ৪৪৬।
- বিস্তারিত দেখুন, Moudud Ahmed: Era of Sheikh Mujibur Rahman, (1984), p. 228-230.
- ২৮ জানুয়ারি তারিখে আব্দুল মালেক উকিল স্পীকার নির্বাচিত হন।
- ব্যরিস্টার এম এ হালিম, পৃ. ৪৪৭, টীকা দ্রষ্টব্য।
- ব্যারিস্টার এম এ হালিম, বিস্তারিত, মেজর রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ: সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট, পৃ. ৪৩-৪৫। Lawrence Lifschultz: Bangladesh: The Unfinished Revolution, p. 6-7. Anthony Mascarenhas: Bangladesh: A Legacy of Blood, p. 95-98.
- যেহেতু মার্শাল ল’ এর অধীনে সংবিধান বলবৎ ছিল সুতরাং ৫৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা স্পীকারের। কিন্তু ৬ নভেম্বর ভোরে অর্থাৎ সায়েম রাষ্ট্রপতি হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে মোস্তাক প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে The Proclamation (Second Amendment) Order 1975-এর মাধ্যমে সংবিধানের ৫৪নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পরিবর্তন করে প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বিধান করেন।
- স্বপন চক্রবর্তী, ধ্রুবপদ বুদ্ধিজীবীর নোট বই, সুধীর চক্রবর্তী সম্পা. পৃ. ১৫০-৫১
- তদেব।
- আনিসুজ্জামান, হুমায়ূন আহমেদের শেষ উপন্যাস দেয়াল (ঢাকা: অন্যপ্রকাশ, ২০১৩), সপ্তম মূদ্রণের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
- নিত্যপ্রিয় ঘোষ, ধ্রুবপদ বুদ্ধিজীবীর নোট বই, সুধীর চক্রবর্তী সম্পা. পৃ. ২১২.
- হুমায়ূন আহমেদ, দেয়াল (ঢাকা: অন্যপ্রকাশ, সপ্তম মূদ্রণ, ২০১৩), পৃ. ১১০।
- Lawrence Ziring, Bangladesh: From Mujib to Ershad (Dhaka: UPL, 1994), p. 85.
- Lawrence Ziring, Bangladesh: From Mujib to Ershad p. 102.
- Ibid.
- মো: আবদুল হালিম, সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ (ঢাকা: সিসিব ফাউন্ডেশন, ২০১১), পৃ. ১৮৭।

Associate Professor.
Department of Folklore, University of Rajshahi.