নরোত্তম ঠাকুরের অন্তর্ধান ও প্রেমতলীর বৈষ্ণব মেলা আমিরুল ইসলাম সহকারী অধ্যাপক ফোকলোর বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গ কথা একটি বিশেষণ হিসেবে ‘মেলা’ কথাটি লোকসমাজে ‘বহু’, ‘অনেক’, ‘প্রচুর’ প্রভৃতি বহুত্ববাচক অর্থে যখনই উচ্চারিত হয়; তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমাজে বসবাসরত লোকেদের একত্রে মিলিত হওয়ার একটি প্রতিচ্ছবি। মানবেতিহাসের গোড়ার দিকে উদ্ভিদজাত ও প্রাণীজ উভয়বিধ খাবারের জন্য অবচেতনভাবেই...
" />নরোত্তম ঠাকুরের অন্তর্ধান ও প্রেমতলীর বৈষ্ণব মেলা
আমিরুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক
ফোকলোর বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রসঙ্গ কথা
একটি বিশেষণ হিসেবে ‘মেলা’ কথাটি লোকসমাজে ‘বহু’, ‘অনেক’, ‘প্রচুর’ প্রভৃতি বহুত্ববাচক অর্থে যখনই উচ্চারিত হয়; তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমাজে বসবাসরত লোকেদের একত্রে মিলিত হওয়ার একটি প্রতিচ্ছবি। মানবেতিহাসের গোড়ার দিকে উদ্ভিদজাত ও প্রাণীজ উভয়বিধ খাবারের জন্য অবচেতনভাবেই মানুষ ছিল প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কেবল সংগ্রহ ব্যতিরেকে প্রকৃতির দান এই খাদ্য উৎপাদনে মানুষের কোনো হাত ছিলনা তখন। প্রাণীজ খাবার সংগ্রহের উদ্দেশে শিকারজীবী মানুষের মিলিত হওয়ার পর্যায় থেকেই শুরু হলো উৎসবের। আর এ কারণেই মেলা ও উৎসব শব্দ দু’টি পরস্পরের পরিপূরক। আদিম উৎসবগুলির মাধ্যমে মানুষ কেবল তার খাদ্যের প্রয়োজন মেটাবার পথ খুঁজছিল। তখন ছিল প্রয়োজনই তার কাছে মুখ্য। কালের পরিক্রমায় বিবর্তিত সমাজে মানুষের চাহিদা বা প্রয়োজন নতুন রূপে মোড় নেয়। মানুষের মিলনের এই উৎসবের সাথে কখনো যোগ হয়েছে লাঙলের ফলার দাগ, কখনো ধর্মের ছাপ, কখনো রাজনীতির আঁচড়। আজ মানুষের এই মেলা বা একত্রিত হওয়ার উৎসব কেবল খাদ্য কামনা নয়, বিচিত্র বর্ণ ও প্রকরণে বিভক্ত। বৈচিত্র্য সত্ত্বেও উৎসবের প্রধান বা একমাত্র উপজীব্য বিষয় হলো আনন্দ। রাজশাহীর প্রেমতলীর মেলাও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলীর গৌরাঙ্গবাড়ির খেতুরধামে অবস্থিত বৈষ্ণব ধামে প্রতি বছর তিন দিনব্যাপী মেলা বসে। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে বৈষ্ণব সাধক নরোত্তম দত্তের তিরোভাব তিথি মহোৎসব উপলক্ষে ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে রাজশাহীর খেতুরধাম। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা আসেন খেতুর ধামের এই মেলাতে। মেলা উপলক্ষে এখানে অষ্ট প্রহরব্যাপী তারক ব্রহ্মনাম সংকীর্ত্তন চলতে থাকে। প্রথম প্রহরে দধিমঙ্গল, দ্বি-প্রহরে ভোগ আরতি ও মহন্ত বিদায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছর দুই বাংলার ভক্তদের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না গৌরাঙ্গবাড়ি মন্দিরের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এটিই সবচেয়ে বড় সমাবেশ। বৈষ্ণব মিলন ও উৎসব উপলক্ষে ভক্তদের আগমন শুরু হয় কয়েক দিন আগে থেকেই। পাঁচ বর্গ কিলোমিটারের অধিক এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আয়োজিত মেলা নির্বিঘœ করতে মাঠে থাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েকটি টিম ও ট্রাাস্টি বোর্ডের শত শত স্বেচ্ছাসেবক। লাখো মানুষের সমাগমের মধ্যে মেলা স্থানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দায়িতে¦ থাকে পাঁচ শতাধিক পুলিশ। ধর্মীয় স্থানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা পুণ্যপ্রার্থী হাজারো ভক্তকুলের জন্য রাখা হয় নিরাপত্তা বলয়। কড়া নজর থাকে পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ও এলিট ফোর্স র্যাবের। জানা যায়, সারা পৃথিবীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মোট ছয়টি ধাম রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটিই ভারতবর্ষে। একটি মাত্র বাংলাদেশে। আর তা হলো এই খেতুরধাম। গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্য ও মহাজনগণ খেতুর ধামকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তিন ধামের (বৃন্দাবন, পুরী ও নবদ্বীপ) একত্র ও পূর্ণ প্রকাশ বলে বিবেচনা করেন। দেশ বিদেশ থেকে আসা পুণ্যার্থীরা মনে করেন, এ ধামে একরাত যাপন করলে তিন ধামের রাত যাপনের সমান পুণ্য লাভ হয়। তাই সনাতন হিন্দু ধর্মে পূজারীরা প্রতিবছর এ সময় গৌরাঙ্গ বাড়িতে সমবেত হয়ে দিনরাত কীর্তন, দেবীর ভোগ গ্রহণ ও পূজা করার মধ্য দিয়ে তিন দিন অতিবাহিত করেন।
প্রেমতলীর মেলার বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক চরিত্র
সনাতন হিন্দু-বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারক নরোত্তম ঠাকুর ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী পদ্মাতীরের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে প্রেমতলী খেতুরধামে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবসেবায় কাজ করেছেন। রাজশাহী মহানগরী থেকে পশ্চিম দিকে ১৭ কিলোমিটার দূরে পদ্মাতীরের এ বৈষ্ণবধাম ভারতীয় উপমহাদেশের শত শত বছরের প্রাচীন ধর্মীয় মিলন মেলা। ধর্মীয় আচারে এটিকে বৈষ্ণব মহামিলনও বলা হয়। খেতুরধাম বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থানও। যাকে ঘিরে বৈষ্ণব অনুসারীদের এ মহামিলন, সেই নরোত্তম দত্ত ঠাকুরের বাবা ছিলেন জমিদার কৃষ্ণানন্দ দত্ত মজুমদার। ধনী বাবার একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ঐশ্বর্য তার জীবনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। তিনি ছোটবেলা থেকে ধর্মপরায়ণ, সংসার বৈরাগী ও উদাসীন প্রকৃতির ছিলেন। ঠাকুর নরোত্তম দত্তের বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার, সমাজ-সংস্কার ও মানবসেবার কাছে হার মেনে সমাজের বহু ধনী, ভূ-স্বামী, দুর্দান্ত নরঘাতক, ডাকাত তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েন বলে প্রচারিত আছে। জীবদ্দশায় নরোত্তম দত্ত নিজ গ্রাম গোপালপুরের সন্নিকটে খেতুরীতে আশ্রম নির্মাণ করে ধর্ম সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। এখানে তিনি সাধারণ বেশে অবস্থান করেছিলেন। বাবার অনুরোধ উপেক্ষা করে, বিলাস পরিত্যাগ করে তিনি স্থানীয় কৃষ্ণমন্দিরে প্রায় সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। ধর্ম সাধনায় তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করেছিলেন। যার প্রভাবে গৌড়িয় বৈষ্ণব সমাজের মধ্যে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নরোত্তমের দ্বিতীয় প্রধান অবদান বৈষ্ণব সমাজে পদাবলী কীর্তন বা লীলা রসকীর্তনের প্রবর্তন করা। বাংলা সংগীত জগতের বিবর্তনের ইতিহাসে পদাবলী কীর্তন প্রায় চারশ’ বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে রয়েছে। শুধু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ই নয়, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সর্বত্রই জাতি নির্বিশেষে এর আবেদন সমান। আর সে জন্যই এ রসকীর্তন ধারার প্রবর্তক নরোত্তম দত্ত বিপুল যশের অধিকারী হন। তার সাহিত্যকর্ম মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যের ইতিহাসে অতুলনীয় সম্পদ। নরোত্তম দাস ঠাকুর অহিংসার মহান সাধক ছিলেন। ভক্তদের নাম প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী প্রেমভক্ত নরোত্তম দাসের তিরোভাব মহোৎসব শুরু হয়। বৈষ্ণব ধর্মাচারে বিশ্বাসী দেশ-বিদেশের সন্ন্যাসভক্তদের পদচারণ আর অষ্টপ্রহর কীর্তন ও প্রসাদ গ্রহণে মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ জমজমাট থাকে বছরের তিনটি দিন। বাংলা কার্তিক মাসের প্রথম দিনে শুরু হয়ে ৩ তারিখে ভক্তদের গঙ্গাস্নানের পর দীর্ঘ প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হয় এই মেলা। ফোকলোর গবেষক ড. অনুপম হীরা ম-লের ভাষায়, ‘খেতুর মেলা মূলত সন্ন্যাসীদের মেলা। অহিংসা ও মানবপ্রেমে বিশ্বাসী অন্য ধর্মের অনুসারীরাও আসেন মেলায়। ভারতের নবদ্বীপ ধাম থেকে কয়েক শ’ সন্ন্যাসী এ মেলায় আসেন। এখানে নেপাল, ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকেও বেশ কিছু ভক্ত আসেন। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত এখানে মহোৎসবে যোগদান করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ঝাড়খ-, উড়িষ্যা, মণিপুর ইত্যাদি রাজ্য থেকে বৈষ্ণব ভক্তরা এখানে এসে সমবেত হয়। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্তের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে খেতুর ধাম। বৈষ্ণব ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হয় সন্ন্যাসী ও বাউল ভক্তরা। আসামের কামাক্ষা থেকে প্রতিবছর এখানে সন্ন্যাসীদের আগমন ঘটে। ভারত ছাড়াও নেপালের পুণ্যার্থীরা এই মেলায় আসে। এছাড়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)-এর উদ্যোগে ফ্রান্স, আমেরিকা, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ থেকে ভক্তরা এই মেলায় আসে। হাজার হাজার ভক্তের পদচারণা আর প্রার্থনায় প্রেমতলী আর গৌরাঙ্গবাড়ি মুখরিত হয়ে ওঠে। মেলা উপলক্ষে তৃতীয় দিনে গোদাগাড়ী এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ২৪ ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই মেলাকে ‘বৈষ্ণবের মহামিলন’ বলে অভিহিত করা হয়।’
মেলার সময় গৌরাঙ্গ বাড়ির চারিদিক থেকে লোক আসতে থাকে। ভক্তদের অনেকে সদলবলে কীর্তন করতে করতে উৎসব প্রাঙ্গনে ঢোকে। তাদের মধ্যে কেউ মৃদঙ্গ, কেউ করতাল, শঙ্খ, হারমোনিয়াম, বেহালা ইত্যাদি বাজিয়ে নগর কীর্তন করতে করতে উৎসব স্থলে প্রবেশ করে। তিন দিনব্যাপি নামকীর্তন চলে। তৃতীয় দিন হলো অষ্টপ্রহর নামকীর্তনের নির্ধারিত দিন। অধ্যাপক অনুপম হীরা ম-লের ভাষায়, ‘শ্রী চৈতন্য তিরোধানের পাঁচ দশক পর পদাবলী কীর্তনের সূত্রপাত হয়। নরোত্তম ঠাকুর এই প্রথাবদ্ধ পদাবলী গায়নের সূত্রপাত করেন। তিনি ১৫৮৩ মতান্তরে ৮৪ খ্রিস্টাব্দে খেতুরিতে এক বৈষ্ণব মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে তিনি সর্বপ্রথম গৌরচন্দ্রিকা গায়নসহ প্রণালীবদ্ধভাবে লীলাকীর্তন গাওয়ার প্রস্তাব করেন। এই উৎসবে উপস্থিত বৈষ্ণব কবি, দার্শনিক, রসবেত্তা ও গায়কেরা সেটি অনুমোদন করেন। তখন থেকে খেতুরি উৎসব ব্রজবুলির পদ এবং গৌরচন্দ্রিকা গায়নসহ প্রণালীবদ্ধ লীলাকীর্তনের প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠে। নরোত্তম যে পদাবলীকীর্তন প্রবর্তন করেন তার বৈশিষ্ট্য হলো লীলাকীর্তনের পূর্বে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া, পরিবেশনের জন্য যে পালা গঠিত হবে তাতে পদকর্তাদের মর্মানুসারী পদ সংকলন, মৃদঙ্গের ব্যবহার, তালছন্দ রচনা এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কীর্তন আলাপের মধ্য দিয়ে কীর্তন পরিবেশন। এভাবে নরোত্তম প্রবর্তিত কীর্তনের একটি আলাদা ঘরানা তৈরী হয়। খেতুরি ছিল রাজশাহীর গড়েরহাটী পরগণার অধীন। উৎস স্থলের নামানুসারে এই কীর্তন ধারার নাম হয় গরানহাটী বা গড়েরহাটী ঘরানা।’
অর্থনৈতিক প্রভাব
খেতুুরধামসংলগ্ন প্রেমতলীর মেলা উপলক্ষে এতদঞ্চলের অর্থনীতি সচল হয়ে ওঠে। উৎপাদক, বিক্রেতা, মধ্যস্বত্বভোগী, ক্রেতা, দর্শক, বাজিগর প্রভৃতি শ্রেণির লোক চারিদিক থেকে মেলায় আসতে থাকে। ভক্ত, দর্শনার্থী, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, গবেষক, ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ মেলায় আসে তাদের প্রাণের টানে। এছাড়া এই মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পেশাজীবী শ্রেণি তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। মেলা প্রাঙ্গনের চারি দিক ঘিরে থাকে নানা প্রকার দোকান। একেক দিকে একেক প্রকার দোকানীদের পসরা সাজিয়ে বসতে দেখা যায়। কোথাও বাদ্যযন্ত্র বিশেষ করে মৃদঙ্গ, পূজার উপকরণ ও ধর্মীয় গ্রন্থ বিক্রি হয়। এই সব স্থানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের উপর তাদের প্রচারমূলক গ্রন্থ বিক্রি করে। অন্য দিকে থাকে নানা প্রকার খাবারের দোকান। মাছ-মাংসসহ ভাত খাওয়ার হোটেল যেমন দেখা যায় তেমনি নিরামিষ খাবারেরও দোকান লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া অস্থায়ী বিভিন্ন মিষ্টির দোকান গড়ে ওঠে। খেতে পাওয়া যায় চিড়া- দৈ, ডালপুরি, সিঙ্গাড়া, পিঁয়াজি ইত্যাদি মুখরোচক খাবার। দেখা যায় চানাচুর, খোরমা, চিনাবাদাম, বাতাসা, খাজা ইত্যাদির দোকান। এই সকল দোকান পেরিয়ে জমে ওঠে মনোহরী পট্টি। এখানে বিভিন্ন প্রকার প্রসাধনী, খেলনা ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। কুমারদের দোকানে দেখা যায় হাড়ি, পাতিল, মাটির পুতুল, ব্যাঙ্ক, খেলনা, ফুলদানী, গয়না, টেরাকোটা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ছুতারেরা বিক্রি করে কাঠের তৈরী জিনিসপত্র। এর মধ্যে পিড়ি, জলচৌকি, খাট, পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল, আলমারী, আলনা, শোকেস, ড্রেসিংটেবিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কামারদের তৈরী জিনিসপত্রের মধ্যে দা, কুড়াল, খোন্তা, কোদাল, শাবল, বটি, কাঁস্তে, ছুরি, হাঁসুয়া, চাপাতি, নাঙ্গলের ফলা, নারকেল কোরানী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেলার বাইরের দিকে খোলা মাঠে দেখা যায় সার্কাস প্যা-েল। এর কিছু দূর গিয়ে দেখা যায় নাগরদোলা। পুরো উৎসব স্থল জুড়ে ভক্তরা শুয়ে-বসে কাটায়। অনেক ভক্তদের রান্ন্া করা উপকরণ নিয়ে আসতে দেখা যায়। এছাড়া মেলায় চাল-ডাল-আনাজ-তরকারী কেনার ব্যবস্থাও থাকে। সেখান থেকে ভক্তরা রান্নার উপকরণ কিনে নিয়ে রান্না করে। আবার মন্দির কর্তৃপক্ষ ভোজের ব্যবস্থা করে। অনেক ভক্ত পূর্বপুরুষের নামে, দেবতার নামে ভোগ উৎসর্গ কওে ভক্তদের খাওয়ায়। মেলার উৎসবকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে এতদঞ্চলের অর্থনীতি।
শ্রী নরোত্তম ঠাকুরের জীবন ও কিংবদন্তী
বলা হয়ে থাকে, মহাপ্রভু নিত্যানন্দের অপ্রকটের পর শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু যেমন তার দ্বিতীয় কলেবররূপে তার আদিষ্ট কর্ম করে গেছেন সেইরূপে নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ও নিত্যানন্দের ন্যায় প্রেমভক্তি বিতরণ করে তৎকালীন সমাজের জীব উদ্ধার করেছিলেন। শ্রীনিবাস জন্মের বহু পূর্বেই মহাপ্রভু গম্ভীরা মন্দিরে বসে ভাবাবেশে ‘শ্রীনিবাস’ ‘শ্রীনিবাস’ বলে যেরূপ ডেকেছেন, নরোত্তমের বেলাতেও সেইরূপ অলৌকিক ঘটনার পরিচয় পাওয়া যায়। মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে নবদ্বীপ হতে তিনি যখন পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে আসেন তখন পদ্মানদীর তীরে বেশ কিছুদিন বাস করেছিলেন। পদ্মবতী স্বয়ং ভগবানের পাদস্পর্শে একেবারে উথলিয়া উঠিলেন এবং মহাপ্রভু তখন পদ্মাবতীকে কৃপা করে বলেছিলেন যে “পদ্মা তুমি আমার এই প্রেম তোমার বক্ষে ধারণ করো এবং নরোত্তম নামে আমার এক প্রিয় ভক্ত এই প্রেমধারণের একমাত্র আধার এবং তোমার সমীপে সে আসিলে তাকে তুমি এই গুপ্তধন প্রদান করিবে।” তখন পদ্মবতী সশরীরে আবির্র্ভূতা হয়ে করজোড়ে নিবেদন করলেন যে “প্রভু আমি কিরূপে তোমার নরোত্তমকে চিনিতে পারিব?” তখন মহাপ্রভু বলিয়াছিলেন যে:
‘যাহার পরশে তুমি অধিক উছলিবা
সেই নরোত্তম প্রেম তারে দিবা।’
‘সেই হতে পদ্মবতী মহাপ্রভুর প্রদত্ত প্রেমধন স্বীয় বক্ষে ধারণ করে উৎকণ্ঠায় দিন গুণতে লাগলেন যে কবে সেই নরোত্তম আসবেন। এরপর আবার যখন মহাপ্রভু রূপ সনাতনকে কৃপা করবার মানসে রামকেলী সন্নিকটে আসেন যখন মহাপ্রভু রূপ সনাতনকে দেখয়া “নরু নরু” বলে কাহাকে যেন সম্বোধন করে ডেকেছিলেন। কিন্তু কে এই “নরু” তা কেউ বুঝতে পারলেন না।’
শৈশব ও কৈশোর
তৎকালে রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্ত ছিলেন মুসলমান জায়গীরদারের অধীনে এক বিস্তৃত ভূখ-ের জমিদার। এবং তার এলাকা ছিল গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত খেতুরী গ্রামে। তার পরমা ভক্তিমতি স্ত্রীর নাম ছিল নারয়ণী দেবী। সেই নারায়ণী দেবীর গর্ভে নরোত্তমের আবির্ভাব হয় ১৫৩১ খৃষ্টাব্দের মাঘী পূর্ণিমার দিনে। পিতা রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্ত এবং মাতা নারায়ণী দেবী এই সর্বসুলক্ষণযুক্ত পুত্ররতœ পেয়ে আনন্দে অধীর হয়ে গেলেন এবং রাজা কৃষ্ণানন্দের পিতা পৌত্রের কল্যাণার্থে বহু ধনরতœ দান করলেন যাতে সকলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তার পৌত্র বংশের মুখোজ্জ্বল করতে পারেন। মুখোজ্জ্বাল নরোত্তম ঠিকই করেছিলেন কিন্তু পিতামাতার মনোবাসনা নরোত্তম ঠিক পূরণ করতে পারেন নাই। কারণ, তারা চেয়েছিলেন যে তিনি সংসারি হয়ে ঐশ্বর্য ভোগ করুন। কিন্তু তিনি তা না করে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর ন্যায় হেলায় পরিত্যাগ করেছিলেন জাগতিক সুখ-সুবিধা। মহাপুরুষগণের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে জন্মক্ষণ এবং শৈশবকাল হতেই তাদের মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবসকল পরিলক্ষিত হয়। ক্রমে নরোত্তমের অণœপ্রাশনের সময় উপস্থিত হলো এবং মহাধুমধামের মধ্য দিয়ে সেই উৎসব পালিত হলো। শুভক্ষণে সেই অন্ন যখন শিশুর মুখে দেওয়া হলো তখন অবোধ শিশু তার মুখ ফিরিয়ে নিল এবং কিছুতেই সেই অণœ তার মুখে দেওয়া গেল না। তখন একজন দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ বললেন যে কেউ যেন অযথা উৎকণ্ঠিত না হন, কারণ এই শিশু বিষ্ণু প্রসাদিত অন্ন ব্যতীত কিছুই গ্রহণ করবে না। অবশেষে শিশু আনন্দিত মনে তা গ্রহণ করলো। সেইদিন হতে নরোত্তমের পিতা আদেশ করলো যে বিষ্ণুভোগ ব্যতীত যেন শিশুকে কিছু খাওয়ান না হয়। সেই হতে রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্ত বিষ্ণুপ্রসাদের মাহাত্ম্য হৃদয়াঙ্গম করলেন। ক্রমে নরোত্তম পাঠে মনোনিবেশ করলেন এবং বালকসুলভ চপলতা থাকলেও একটা উদাসীন ভাব তার মধ্যে যেন পরিলক্ষিত হতো। পুত্রের এই উদাসীনতার কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে পিতা-মাতা অবশেষে স্থির করলেন যে বিবাহ দিলে হয়তো এর প্রতিকার হবে। এই সময় গ্রামবাসী পরমদভাগবদ এক ব্রাহ্মণ নরোত্তমের সংস্পর্শে আনলেন যার নাম ছিল কৃষ্ণদাস। তিনি নরোত্তমকে দেখেই বুঝতে পারলেন যে এই বালক ভবিষ্যতে কী হবে। তিনি তাকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে গৌরকথা এবং শ্রীনিবাস আচার্য প্রসঙ্গ সব শোনাতেন, আর নরোত্তম এই সকল লীলা কথা শ্রবণ করতে করতে প্রেমাশ্রু বর্ষণ করতেন।
তখন নরোত্তম শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য ব্যাকূল হয়ে পড়লেন; যেরূপ ব্যাকূলতা দেখা দিয়োছল অবধূত নিত্যানন্দ প্রভুর বেলাতে এবং যার ফলে তিনি বৃন্দাবন হতে নবদ্বীপে চলে আসেন। নিত্যানন্দের দ্বিতীয় কলেবর হলেন নরোত্তম এবং সেই হেতু নিত্যানন্দ প্রভু একদিন স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাকে দর্শন দিয়ে বললেন, “নরোত্তম প্রভাতে তুমি পদ্মায় ¯œান করিতে যাইবে কারণ পদ্মাবতীর নিকট তোমার জন্য শুদ্ধপ্রেম সঞ্চিত আছে এবং পদ্মা¯œান করলে তোমার অভিষ্ট সিদ্ধ হইবে।” সেই স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী নরোত্তম প্রভাতে পদ্মানদীতে ¯œান করতে গেলেন। মনের মধ্যে প্রচ- আলোড়ন যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন তার বাস্তবতা কতখানি তা পরীক্ষা করবার মানসে। অবশেষে যোগমায়াদেবীর কৃপায় অঘটন সংঘটিত হলো। পদ্মা¯œানকালে তিনি দেখলেন যে গৌরবর্ণ এক মহাপুরুষ হাসতে হাসতে তার হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং তার শরীরের সাধারণ রং ও পরিবর্তিত হয়ে উজ্জ্বল গৌরবর্ণ ধারণ করলো। নরোত্তমের দেহস্মৃতি লোপ পেল এবং তিনি ভাবাবেশে “হা গৌর, কোথা, কোথা আমার প্রাণনাথ” বলে হাহাকার করতে লাগলেন। সঙ্গের লোকজনেরা হঠাৎ তার এই ভাবান্তর দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে গেলেন এবং ঘটনার পর হতে নরোত্তমের জীবনে আর এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।
এরা সব চিহ্নিতদাস সুতারাং মহাপ্রভু অপ্রকট হলেও তার কৃপাশক্তিতে ধীরে ধীরে পট-পরিবর্তন হতে লাগলো। মনে প্রচ- বিষয়- বৈরাগ্য, ক্রমাগত প্রেমাশ্রু বর্ষণ আর ঘনঘন মহাপ্রভুর পরিকরগণের নাম উচ্চারণ করে করে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন। ¯œান নাই, আহার নাই, নিদ্রা নাই তিনি যেন একেবারে পাগলের মত হয়ে গেলেন। নিতাই গৌরাঙ্গের কৃপায় বাতাস গায়ে লাগলে যে এই দশা হয় তা রঘুনাথ দাস গোস্বামী, রূপ সনাতন প্রমুখ গোস্বামী চরিত্রে দেখা যায়। পিতা রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্ত পুত্রকে প্রায় বন্দী করে রাখলেন কিন্তু যে কথা রঘুনাথ দাস গোস্বামীর পিতা বলেছিলেন, “দড়ির বন্ধনে তাকে রাখিব কেমনে-জন্মদাতা পিতা নারে প্রারদ্ধ খ-াইতে,” এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হলো। ভক্তের এই কষ্টে এবং আর্তিতে মহাপ্রভু আর স্থির থাকতে পারলেন না এবং একদিন স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বললেন,“নরোত্তম তোমার ব্যাকুলতায় আমি স্থির থাকতে পারছি না, শীঘ্রই তোমার সংসার-বন্ধন ছিন্ন হবে এবং তুমি বৃন্দাবনে গমন করবে আর সেখানে গিয়ে লোকনাথ গোস্বামীর শ্রীচরণে আশ্রয় গ্রহণ করবে”-ইত্যাদি কথা। কিংবদন্তী আছে, এই দীক্ষার ইঙ্গিত লোকনাথ গোস্বামীকেও দিয়েছিলেন স্বপ্নের মাধ্যমে, যখন তিনি প্রথম নবদ্বীপ হতে বিদায় হয়ে বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন।
বৃন্দাবন যাত্রা
স্বীয় পিতা রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্তকে একবার রাজকার্য উপলক্ষে বাইরে যেতে হলো এবং নরোত্তম সেই সুযোগে জননীর নিকট হতে কৌশলে বিদায় গ্রহণ করে বৃন্দাবন অভিমুখে পালিয়ে গেলেন। আহার নাই, নিদ্রা নাই, পথশ্রমে দেহমন ক্লান্ত আর দিবারাত্রি গৌরাঙ্গের জন্য ব্যাকুলতা- রাজনন্দনের এই দশা ভাবলে মন সত্যই যেন কেমন উনমনা হয়ে যায়। ক্লান্ত এবং অবসন্ন দেহে নরোত্তম আর পথ চলতে পারেেছন না, অনাহারে দেহমন শীর্ণ, এমতাবস্থায় বৃক্ষতলে নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। এমনই এক সময়ে তন্দ্রার আবেশে দেখলেন যে গৌরবর্ণ এক ব্রাহ্মণ একভা- দুধ নিয়ে উপস্থিত হয়ে তাকে তা পান করতে অনুরোধ করছেন। পানাহারের জন্য কোনো চেষ্টাই তার নাই এবং অপ্রাকৃত সেই দুধ সেই অবস্থাতেই র’ল এবং তিনি পুনরায় নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। তখন রূপ-সনাতন আর স্থির থাকিতে পারলেন না এবং স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাকে বললেন “নরোত্তম, তুমি এ কি করলে? মহাপ্রভু স্বয়ং দুগ্ধ এনে তোমায় পান করবার জন্য দিয়ে গেলেন আর তুমি তা উপেক্ষা করলে? ‘নরোত্তম তুমি ধন্য, শীঘ্রই এটা পান করো’- ইত্যাদি। নরোত্তম, এইরূপ স্বপ্ন দেখে চমকে উঠলেন এবং অপ্রাকৃত সেই দুধ পান করে পুনরায় দেহে শক্তি পেলেন।
লোকনাথ গোস্বামীর সাহচর্য
এইভাবে প্রভুর সঞ্চারিত শক্তির দ্বারা নরোত্তম মথুরার বিশ্রামাঘাটে এসে পৌঁছলেন এবং সেখানে এসে রূপ-সনাতনের অপ্রকট বার্তা শ্রবণ করে শোকে দুঃখে একেবারে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। এদিকে আবার শ্রীরূপ গোস্বামী স্বপ্নের মাধ্যমে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুকে বলে দিলেন যে আগামীকল্য নরোত্তম বৃন্দাবনে আসবেন। অবশেষে লোকনাথ গোস্বামীর ভজন কুটিরে শ্রীজীব গোস্বামী এবং শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর সহিত তার মিলন হলো। নরোত্তম শ্রীগুরু চরণে আত্মসমর্পণ করলেন এবং শ্রীনিবাস আচার্য তাকে তার সুশীল বক্ষে ধারণ করলেন। মাতৃহারা পিতৃহারা রাজনন্দন এতদিনে যেন তার প্রকৃত আশ্রয় খুঁজে পেলেন। পূর্বের স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী নরোত্তম শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর নিকট তার মনোবাসনা নিবেদন করলেন, কিন্তু তখনও পর্যন্ত লোকনাথ গোস্বামী কাউকেও দীক্ষামন্ত্র প্রদান করেন নাই এবং তার সংকল্প যে, শিষ্যের গুরুদায়িত্ব জীবনে তিনি বহন করবেন না। কিন্তু নরোত্তম নাছোড়বান্দা, ‘তিনিও সংকল্প করেছেন যে দীক্ষামন্ত্র তিনি নেবেন তার নিকট হতে এবং তিনি যদি সেই সঙ্কল্পকে বাস্তবে রূপায়িত করতে না পারেন তা হলে দেহত্যাগ করবেন- অর্থাৎ মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’। নিরাসক্ত লোকনাথ অযাচক বৃত্তি অবলম্বন করে তার ভজন কুটিরে থাকেন। দিবারাত্র সাধনভজনে মগ্ন, কথাটি পর্যন্ত বলেন না, কারণ তিনি মনে করেন যে সে সময়টুকুর অপচয় হবে। নরোত্তম তার কৃপাদৃষ্টি পাবার জন্য তার ভজন কুটিরের নিকট এক ঝুপড়িতে বসে গুরুধ্যানে মগ্ন। তার মনে মনে ধারণা যে এত কাছে থাকলে নিশ্চয়ই একদিন না একদিন লোকনাথ গোস্বামীর সহিত কথাবার্তা হবেই। কিন্তু লোকনাথের প্রতিজ্ঞা ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, শিষ্যত্বে তিনি কাউকেই বরণ করবেন না। আবার এদিকে নরোত্তম তার সঙ্কল্পে অনড়। গুরুপদে তাকে বরণ করবেনই। গুরু হলো সঙ্কল্পের যুদ্ধ। কে হারে কে জেতে? অবশেষে, এতদিন প্রতীক্ষার পর তিনি তার গুরুদেবের শ্রীমুখ হতে একটা সম্বোধনবাণী শ্রবণ করতে পারলেন। লোকনাথ গোস্বামী তখন আদ্যেপান্ত সব ব্যাপার অবগত হলেন এবং এরূপ আর্তি ও নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে তার মন গলে গেল এবং অবশেষে তিনি দীক্ষামন্ত্র দিতে স্বীকার করলেন। অবশেষে শুভদিনে শুভক্ষণে শ্রীজীব গোস্বামী এবং শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর ব্যবস্থাপনায় নরোত্তম চিরবিক্রিত হয়ে গেলেন লোকনাথ গোস্বামীর শ্রীচরণে। লোকনাথ গোস্বামী তখন তাকে সাধ্য সাধন বিষয়ে নানা উপদেশ প্রদান করলেন এবং আদেশ করলেন যে তিনি যেন কখনও দার পরিগ্রহ না করেন। সেই আদেশ অনুযায়ী নরোত্তম চিরজীবন অকৃতদার ছিলেন।
দীক্ষার পর নরোত্তম নিজেকে গুরুসেবার কার্যে নিয়োজিত করলেন এবং শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট হতে গ্রন্থশাস্ত্র অধ্যয়ন করে অচিরে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। শ্রীজীব গোস্বামী তার গুণে এবং পা-িত্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে “ঠাকুর মহাশয়” উপাধিতে ভূষিত করেন।
রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের পরশ
প্রকৃতপক্ষে শ্রীনিবাস আচার্যের সাহচর্যে অতি অল্পকালের মধ্যেই তার জীবনে ভক্তিলতা ফুলেফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। একদা লীলারস উপভোগ করবার মানসে নরোত্তম ঠাকুর সমাধিস্থ হন এবং শ্রীরাধিকার সখীগণ সঙ্গে সেই পরিবেশে যেন প্রবেশ করেন। শ্রীরাধিকা হঠাৎ যেন তার সখীগণকে বললেন যে তার ভয়ানক ক্ষুধা পেয়েছে এবং শীঘ্রই যেন তারা কিছু ভক্ষ্য-দ্রব্যের ব্যবস্থা করেন। তৎক্ষণাৎ ললিতাসখীর ইঙ্গিতে নরোত্তম ঠাকুর ক্ষীর প্রস্তুত করে শ্রীরাধিকাকে সমর্পণ করবেন এই বাসনায় দুধ জ্বাল দিয়ে তা নাড়তে লাগলেন। অপ্রাকৃত সেই দুধ জ্বাল যেন উথলে উঠতে লাগলো। তখন নরোত্তম ঠাকুর তাড়াতাড়ি করে শশব্যস্ত সেই পাত্রটি উনুন হতে নামাইলেন এবং এর ফলে তার হাত দগ্ধ হলো। কিন্তু নরোত্তমের সে দিকে কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই, কারণ তিনি তখন লীলার সমুদ্রে ভাসমান। তখন তিনি পরম যতেœ সেই ঘণাবর্ত দুধ ললিতাসখীর কর কমলে অর্পণ করলেন এবং শ্রীরাধিকা ও শ্রীকৃষ্ণ তা ভক্ষণ করে যেন তাদের ক্ষুণিœবৃত্তি করলেন। যখন তার বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসলো, তখন নরোত্তম ঠাকুর দেখলেন যে তার হাতের সব চামড়া পুড়ে গেছে এবং পাছে তা সকলে জানতে পারেন সেই হেতু অতি সত্বর তা সেেঙ্গাপন করবার চেষ্টা করলেন।
খেতুরে প্রত্যাবর্তন
নরোত্তম ঠাকুরের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। তিনি শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর সাথে ভক্তিগ্রন্থ প্রচারের উদ্দেশ্যে গৌড়দেশ যাত্রা করেন এবং পথিমধ্যে গ্রন্থ চুরি হয়ে হেলে শ্রীনিবাসের আদেশ অনুযায়ী তিনি খেতুরীতে প্রত্যাগমন করেন। তার তখন পূর্ণ সন্ন্যাসবেশ, পরিধানে জীর্ণ কৌপিন ও বহির্বাসও সর্বদা নিতাই গোরাঙ্গ ধ্যানে মগ্ন। মাতাপিতা এতদিন পরে পুত্রকে দেখে বহুদিনের অদর্শন জ্বালা জুড়ালেন এবং নরোত্তমকে পুনরায় সংসার আশ্রমে ফিরিয়া আসতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু নরোত্তম তখন আর রাজনন্দন নন, তখন তিনি সন্ন্যাসী নরোত্তম ঠাকুর। পিতা রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্ত হতাশ মনে পুত্রের পরিবর্তে ভ্রাতুষ্পুত্র সন্তোষ দত্তের ওপর রাজ্যভার দিয়ে অবসর গ্রহণ করলেন। সন্তোষ দত্তের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তিনি আজীবন বৈষ্ণব- সেবার জন্য রাজ্যভা-ার উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন। তিনি রাজা ছিলেন বটে, প্রকৃতপক্ষে মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন দাস। নরোত্তমের মনোবাসনাকে রূপায়িত করতে শ্রীসন্তোষ দত্ত মহাশয় অক্ষরে অক্ষরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময় তিনি গৌড়ম-লের বিভিন্ন স্থান পরিক্রমা করে খেতুরীতে ষড়বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বাসনা প্রকাশ করেন শ্রীনিবাস আচার্য সমীপে। শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর সম্মতি পেয়ে নরোত্তম তখন ষড়বিগ্রহ প্রস্তুত করবার জন্য ভাষ্করকে নিযুক্ত করেন এবং এই ষড়বিগ্রহের নাম তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছিলেন:
“ গৌরাঙ্গ বল্লভীকান্ত শ্রীব্রজমোহন
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকান্ত শ্রীরাধারমণ।”
শ্রীবিগ্রহ প্রস্তুত পর নরোত্তমের মন খুবই বিষণœ হয়ে গেল, কারণ আসলে মহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহ তার মনোমতো হলো না। কারণ তিনি যেন সেই শ্রীবিগ্রহের মধ্যে প্রকৃত লাবণ্য এবং সৌন্দর্যের অভাব বোধ করলেন এবং সেই শ্রীবিগ্রহ পুনরায় নির্মাণ সঙ্কল্প গ্রহণ করলেন। এমনই সময়ে মহাপ্রভু কৃপা করে স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাকে স্বপ্নাদেশ করলেন: “নরোত্তম তুমি আমার বিগ্রহ নির্মাণের সঙ্কল্প পরিত্যাগ করো, কারণ আমি যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলাম তখন আমার দ্বিতীয় দেহ প্রকাশ করে গঙ্গাগর্ভে রেখেছিলাম এবং এখন বিগ্রহ এই গ্রামের বিপ্রদাসের ধান্যগোলার মধ্যে আছে এবং তুমি তা উদ্ধার করে সেবা প্রকাশ করো।”
নরোত্তম সেই বিপ্রদাসের গৃহে গিয়া উপস্থিত হলেন এবং জানতে পারলেন যে, ‘তার গৃহের সীমানার মধ্যে একটি অতি প্রাচীন ধান্যগোলা আছে এবং সেখানে একটি বিরাট বিষধর সাপ বাস করে এবং সাপভয়ে কেউ তার ধারেও যায় না। নরোত্তম সমস্ত ভয়কে উপেক্ষা করে শতসহ¯্র সমবেত জনতার নিষেধ না মেনে একাকী সেই ধান্যগোলার মধ্যে প্রবেশ করলেন। তখন বিরাটাকার সেই সাপ গর্জন করতে করতে সেই ধান্যগোলা হতে নি®্র‹ান্ত হয়ে চলে গেল। নরোত্তম তখন সেই শ্রীবিগ্রহ স্বীয়বক্ষে ধারণ করে ধান্যগোলার মধ্য হতে বের হয়ে আসলেন। সমবেত জনগণ নরোত্তমের মাহাত্ম্য কীর্তনে পঞ্চমুখ হইয়া উঠলেন এবং চতুুর্দিকে এই সংবাদ বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়লে নরোত্তমের প্রতি জনগণের ভক্তি ও শ্রদ্ধা অধিকতর বৃদ্ধি পেলো।’ নরোত্তম তখন আনন্দাশ্রু বর্ষণ করতে করতে প্রেমোন্মত্তভাবে সেই বিগ্রহ নবনির্মিত মন্দিরে স্থাপন করলেন এবং শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর দ্বারা সেই বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা-উৎসব সম্পাদন করবার মানসে সব ব্যবস্থাদি করতে লাগলেন।
রামচন্দ্র কবিরাজের সান্নিধ্য
শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর আজ্ঞা অনুযায়ী চতুর্দিকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠান হলো। এই সময় রামচন্দ্র কবিরাজের সাথে তার বুধরীতে প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরিচয় হয়। রামচন্দ্র নরোত্তম ঠাকুর সম্বন্ধে সবই শ্রবণ করেছেন কিন্তু পরস্পর সাক্ষাৎ হয় নাই। একজন থাকেন পদ্মার এক তীর বুধারীতে, অপর জন থাকেন অন্য তীর খেতুরীতে। এই রামচন্দ্র কবিরাজ যদিও শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য তথাপি এই দু’জনার মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠলো তা যেন এক প্রাণ ভিন্ন দেহ। “ক্ষণমাত্র আদর্শনে যুগসম করি মানে-যাঁচে দোহে দোঁহার সঙ্গতি।” খেতুরীতে এই শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি সন্তোষ দত্তের সহোযোগিতায় এর চমৎকার সুবন্দোবস্ত করলেন। চতুর্দিকে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠান হলো এবং তার ফলে সমস্ত বৈষ্ণব মহন্ত ধীরে ধীরে খেতুরীতে আসতে লাগলেন। বলা হয়ে তাকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আমলে কিংবা তার পরে ভারতের কোথাও এইরূপ বৈষ্ণব সমাবেশ হয় নাই। রাজা সন্তোষ দত্ত তার রাজভা-ার উজাড় করে দিয়েছিলেন।
একাধারে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু, নরেত্তম ঠাকুর, শ্যামানন্দ প্রভু, রামচন্দ্র কবিরাজ অন্যদিকে আবার জাহ্নবা দেবী, অচ্যুতানন্দ, রঘুনন্দন, শ্রীপতি, জিতামিশ্র, কাশীমিশ্র, ঘুমিশ্র, কাশিনাথ প-িত, নয়নমিশ্র, শ্রীপুষ্পগোপাল, রঘুনাথ, দাস নারায়ণ, বিষ্ণুদাস আচার্য, কামদেব, জনার্দন, বনমালী পুরুষোত্তম, যদুনন্দন প্রমুখ বৈষ্ণব মহন্ত খেতুরীতে পদার্পণ করেন এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উৎসবে যোগদান করিবার জন্য। অবশেষে ফাল্গুনী পূর্ণিমা দিবসে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু সেই শ্রীবিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠার কার্য সম্পাদন করলেন।
বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর নরোত্তম ঠাকুর তার কীর্তনীয়া সম্প্রদায় সহযোগে মহাসঙ্কীর্তন যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। রাধারমণ চরণদাস বলেন:
‘প্রকট অপ্রকট লীলায় দুইতো বিধান
প্রকট লীলায় প্রভু করেন নিজে নৃত্যগান
অপ্রকটে নামরূপে স্বয়ং ভগবান
কীর্ত্তন বিহারীরূপে সদা বর্তমান।’
‘জাহ্নবা দেবী নরোত্তমের মহিমা কীর্তন করতে করতে বলেন:
পূর্ণ অনুগ্রহ নরোত্তম শ্রীনিবাসে
যে আজ্ঞা করিল প্রভু তা সত্য হইল
আচ-াল প্রভৃতি মাতিল প্রভুগুণে
খ-িল সবার তাপ প্রেম বরিষণে।’
দলে দলে লোক এসে নরোত্তমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হরিনাম, রামকৃষ্ণ এবং গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী তার শিষ্যদের মধ্যে সর্বপ্রধান। নরোত্তম বৈষ্ণবজগৎকে যে ভক্তিমূলক গান এবং পদাবলী উপহার দিলেন তা বৈষ্ণব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। যাত্রাকালে নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় বিরহে এবং বিচ্ছেদ ব্যাথায় ব্যাকুল হয়ে পড়লেন, কারণ তিনি তার সূক্ষ্মদৃষ্টি দ্বারা বেশ বুঝতে পারলেন যে এই তাদের শেষ বিদায়। অন্তিমকালে আর কিছুই চাইলেন না, চাইলেন শুধু রামচন্দ্রের সঙ্গ। ‘না চাহিলেন নিতাই গৌর, না চাহিলেন রাধাকৃষ্ণ, না চাহিলেন শ্রীগুরুদেবকে এবং তৎপরিবর্তে শুধু “রামচন্দ্র রামচন্দ্র” উচ্চারণ করিয়া বুকভরা বেদনা লইয়া’ তিনি জীবনের শেষ কয়েক বৎসর অতিবাহিত করেছিলেন। একাধারে আচার্য প্রভু ও অন্যদিকে রামচন্দ্রের বিয়োগ ব্যথায় তিনি যেন পাগলের ন্যায় হয়ে গেলেন।
গঙ্গাযাত্রা ও অন্তর্ধান
নিয়ত অশ্রুধারা ও বিরহানলে দেহমন জরজর হয়ে গেল এবং অবশেষে নিত্যলীলায় প্রবেশের মানসে তিনি শিষ্যগণের নিকট গঙ্গাস্থানে যাবার বাসনা প্রকাশ করলেন।
তখন শিষ্যগণ তাকে নিয়ে আসলেন। তিনি তিনদিন নীরব হয়ে থাকবার পর সকলে মিলে স্থির করলেন যে তার এই সিদ্ধদেহ চিতাগ্নি দ্বারা দাহ করা হেেব। কিন্তু সমবেত পাষ-ীগণ নরোত্তম ঠাকুরকে উপলক্ষ করে নানাপ্রকার বিদ্রুপাত্মক বাক্যবাণ প্রয়োগ করিতে লাগিল। তাদের বক্তব্যের প্রধান কারণ এই যে নরোত্তম ঠাকুর দত্ত কায়স্থ হয়ে কেন ব্রাহ্মণ সন্তানের শিষ্য করলেন? তখনকার সমাজের রীতি অনুযায়ী এটা বরদাস্ত করা যেত না। সেহেতু, তারা বলতে লাগল যে “কায়স্থ হয়ে ব্রাহ্মণ শিষ্য করার ফলে নরোত্তম বাকরোধ হয়ে জ্বরাক্রান্ত হয়ে মারা গেল”- এ যেন এই পাপের ফল। তখন তারা সকলে গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করেও নানাপ্রকার কটাক্ষ করতে লাগলো, যার ভাবার্থ এই যে নরোত্তমের ন্যায় তার কপালেও অনেক দুর্ভোগ আছে, কারণ তাকে তার ব্রাহ্মণত্বের মর্যাদাহানির মূল্য নিশ্চয়ই দিতে হবে।
নিজের সম্বন্ধে এবং নিজের গুরুদেবের সম্বন্ধে এইরূপ কটাক্ষ ও বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা শ্রবণ করে গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী নরোত্তম ঠাকুরের চিতার নিকট গিয়ে করজোড়ে কাতরভাবে নানাপ্রকার আর্তি ও প্রর্থনা করতে লাগলেন যে, একমাত্র তিনি ব্যতীত কে তাকে এই অসহায় পরিবেশ হতে উদ্ধার করবে। প্রিয় শিষ্যের আকুল ক্রন্দন ও ব্যাকুলতায় নরোত্তম ঠাকুর আর স্থির থাকতে পারিলেন না এবং তৎক্ষণাৎ চিতা হতে “রাধাকৃষ্ণ চৈতন্য” বলে এক হুঙ্কার গর্জন করে উঠে বসলেন। তখন তার সেই দেহ হতে এক অপরূপ স্বর্গীয় জ্যোতি বাহির হতে লাগলো। দেবগণ স্বর্গ হতে পুষ্প বৃষ্টি করিতে লাগলেন এবং চতুর্দিকে একটা মহাহুলুস্থুল পড়েয় গেল ঘটনার এই অস্বাভাবিকতায়। শিষ্যকে বিপদ হতে উদ্ধারকল্পে শ্রীগুরুদেব যে চিতা হতে উঠে আসেন তা একমাত্র নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের জীবনেই দেখা যায়। অর্থাৎ কিনা শ্রীগুরুদেবের পক্ষে সবই সম্ভব, যদি কোনো শিষ্য প্রকৃত আনুগত্য এবং সেবার দ্বারা তার মনোভাবকে রূপায়িত করতে পারেন। গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী তখন তাকে এইসব পাষ-ীদের উদ্ধারকল্পে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করতে লাগলেন, কারণ ক্ষমাই মহতের ধর্ম। এই ঘটনার পর হতে নরোত্তম ঠাকুরের মহিমা আরও শতসহ¯্রগুণে বৃদ্ধি পেল। জীবোদ্ধারকল্পে তিনি বেশ কিছুদিন দেহ ধারণ করে স্বীয়কার্য করে গিয়েছিলেন কিন্তু পরিবেশে নিত্যলীলায় প্রবেশের মানসে পুনরায় গঙ্গা¯œানের বাসনা প্রকাশ করলেন। তখন শিষ্যগণ মিলিতভাবে তাকে গাম্ভীলার ঘাটে নিয়ে আসলেন এবং তখন তিনি গঙ্গাজলের মধ্যে নিজদেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয়শিষ্য গঙ্গানারায়ণ এবং রামকৃষ্ণকে আদেশ করলেন তার দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় তারা তা করতে লাগলেন এবং এক অত্যাশ্চর্য এবং অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটলো। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে পঞ্চভূতের এই দেহ মার্জন করবার ফলে সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিশে গেল। পদ্মাবতীর গর্ভ হতে উৎপত্তি এবং পদ্মাগর্ভে শেষ পর্যন্ত তার দেহ লীন হয়ে গেল। অদ্যপি মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত গঙ্গাতীরে গাম্ভীলার ঘাট বর্তমান এবং সেখানে নরোত্তম ঠাকুরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সেবাপূজা হয়ে থাকে।
উপসংহার
তার দেহসমাধি বলে কিছু নেই, কারণ সবই তো গঙ্গাজলে লীন হয়ে গিয়েছিল। এইভাবে রাজনন্দন নরোত্তম দুর্লভ মানবজনমের চরম সদ্ব্যবহার করে বৈষ্ণব জগতের নিকট ধ্রুবতারকার ন্যায় চিরভাস্কর হয়ে থাকলেন। তার তিরোধান উপলক্ষে যে বৈষ্ণব মিলন মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। খাওয়া ছাড়াও ভক্তদের থাকার জন্য বিভিন্ন বিভিন্ন প্যান্ডেল তৈরী করে দেওয়া হয়। সেখানে তারা রাত্রি যাপন করতে পারে। আবাসনের স্থানেও গুচ্ছবদ্ধ কীর্তন দল দিন-রাত কীর্তন করে। কীর্তনের মধ্যে আছে পালা কীর্তন, নামকীর্তন, গৌর কীর্তন ইত্যাদি। মেলার একদিকে আছে ইসকন সাধুদের প্যান্ডেল। তারা সেখানে কীর্তন করে ও তাদের প্রকাশিত ধর্মীয় গ্রন্থ, পূজার উপকরণ, জপের মালা, গলার মালা, তিলক মাটি, চন্দন ইত্যাদি বিক্রি করে। এই প্যান্ডেলে অনেক বিদেশী ভক্তের আগমন ঘটে। অনেক স্থানে খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগে যিশুর বাণী প্রচার করা হয়। এছাড়া হিন্দু ধর্মের অন্যান্য উপাসক সম্প্রদায়ও এই মেলাকে ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, সৎসঙ্গী, মতুয়া এদের ধর্মগ্রন্থের দোকানও এই মেলায় লক্ষ করা যায়। মূলত প্রেমতলীর প্রাচীন খেতুর মেলা ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র নির্বিশেষে একটি মিলনমেলা হিসেবে বর্তমানে সর্বজনীন চরিত্র লাভ করেছে।
There is no related posts.